Total Pageviews

Tuesday, February 5, 2019

বিহান ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা BIHAN 2nd year 1st issue



শাহীন আখতার
সাক্ষাৎকার

আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
শিল্প কি বিচ্ছিন্ন কিছু? আমি যতদূর বুঝি - ছোটগল্প শিল্পের একটি মাধ্যম। শেষ পর্যন্ত এটি শিল্প হয়ে উঠল কি উঠল না- সে ভিন্ন কথা। এর বিচারই বা কে করবে। শিল্পের সংজ্ঞাও তো সব যুগে এক নয়। তাই ‘শিল্প’ রচনা করছি - এমন কিছু মাথায় নিয়ে গল্প লিখতে না বসাই ভালো।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
গল্পের ক্ষেত্রে আমি প্রাধান্য দেই বা দিতে চাই - নিজের ইচ্ছাকে, অন্তর্গত তাড়নাকে। সে ইচ্ছা বা তাড়নাটি আসতে পারে ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা থেকে, বর্তমান সময়ের বা অতীতের কোনো ঘটনা বা চরিত্র থেকে। একেক সময় একেকটা বিষয় প্রাধান্য পায়। এখন একজন ব্যক্তিমানুষের সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়ার চেয়ে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠী নিয়ে লেখার তাড়না বোধ করি বেশি। সময়টাই মনে হয় এমন। যুদ্ধ, সংঘাত, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা এসবই তো ঘটছে চারদিকে। আরেকটা বিষয় এখন গল্পের কেন্দ্রস্থলে উঠে আসতে চায় মৃত্যু। হঠাৎ করে কাছের মানুষরা চলে যাচ্ছে বলেই হয়তো। মৃত্যুটা শুধু দেহ ছেড়ে আত্মার চলে যাওয়া বা এর বিনাশই নয়, আমার ভাবনায় আসে অনেকগুলো মন, যা স্বজনহারানোর প্রাণান্তকর কষ্ট ভোগ করে, শোকার্ত হয়।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
গল্পটা কীভাবে বলব, সেই তাড়না থেকেই গল্পের ফর্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এটা আলাদা কিছু নয়। ‘অলৌকিক ছড়ি’ ২০১৮ তে লেখা গল্প হলেও ভাবনাটা আসে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। তখন ভরবর্ষায় নাফ পেরিয়ে রোহিঙ্গারা টেকনাফ, কক্সবাজারে আশ্রয় নিচ্ছিল। তাদের আগমনের দৃশ্যটা টেলিভিশন বা খবরের কাগজের স্থিরচিত্রে দেখে মনে হচ্ছিল, এটি বাস্তব দুনিয়ার নয়। এ যেন বাইবেলের Exodus.
নৌকা থেকে নেমে গলাপানি ভেঙে মৌসুমী বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওরা আসছিল। নৌকাডুবিতে ভেসে যাচ্ছিল তাদের নারী-শিশু, যুবক- বৃদ্ধ। তখন এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক রিপোর্ট লেখা হচ্ছিল। টেকনাফ বাজারের খাবারের দোকানগুলোর সামনে ওরা ঘুরঘুর করছে। তখনই গল্পের ছকটা পরিষ্কারভাবে সামনে চলে আসে। আব্রাহামীয় সেমেটিক তিনটি ধর্মেই যে কাহিনি আছে, এমন একটা অতিপরিচিত ধর্মীয় মিথ হবে ‘অলৌকিক ছড়ি’ গল্পের অবলম্বন। যা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে গল্পটাকে আলাদা করে ফেলবে। ‘অলৌকিক ছড়ি’ গল্পের ফর্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমার এটুকুই বলার আছে।
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বাংলা গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো খামতি আছে বলে আমার মনে হয় না। সে কমলকুমার মজুমদার থেকে সুবিমল মিশ্র, সেলিম মোরশেদ। তাঁদের আগে-পরে আরো শ’ খানেক লেখক তো আছেনই, যারা এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টিকে বিশেষভাবে আমলে নিয়ে লিখেছেন, লিখে যাচ্ছেন।
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বাংলা গল্পের বিকাশ থেমে গেছে বলে মনে হয় না। লেখালেখি তো চলছে। অবশ্য পাঠকের এ আকালের যুগে লেখকেরা যে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন- সে বড় আশ্চর্য ঘটনা।

অলৌকিক ছড়ি

ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন... তুমি আপন যষ্টি তুলিয়া সমুদ্রের উপরে হস্ত বিস্তার কর, সমদ্রকে দুই ভাগ কর; তাহাতে ই¯্রায়েল-সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিবে। -বাইবেল

যে সনে হুকুমত কন্যাশিশুদের বাঁচিয়ে রেখে পুত্রসন্তানকে খুন করছিল, সে বছর মুসার জন্ম। তার নাম রেখেছিলেন দাদি বিসমিল্লাহজান। এ উপলক্ষে উৎসব-অনুষ্ঠান কিছুই হয় নাই, আঁতুড়তোলার মামুলি খরচাপাতিও নয়। তবে শিশুর দুনিয়ায় আসার কাফফারাস্বরূপ কাছের পুলিশ ফাঁড়িতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়েছিল। এভাবেই কথাটা বলতেন দাদি বিসমিল্লাহজান, লোকে ‘জন্ম নিবন্ধন’ বলে গালভরা বুলি আওড়ালেও, সেই দাদিকে ছাড়াই গতরাতে নাফ নদীর এপারে উঠেছে মুসা। তখন ও জানত না যে, দাদি নৌকায় নাই। ছয় হাজার কিয়েত দিয়ে দুজনের ভাড়া মিটিয়েছিল। তারপর তো ভয়ানক হুলুস্থুল- কার আগে কে যাবে। ঘুটঘুটে আন্ধার রাত।
দরিয়ার ধু-ধু পানির দিকে তাকিয়ে মুসার চোখ ফেটে নোনাজলের ধারা নামে। দাদির থামির সঙ্গে তার লুঙ্গিটা যদি গিঁট-বাঁধা থাকত, সে কোনোভাবে ভেসে যেতে দিত না দাদিকে। খোদা না করুক, ভেসে যাবে কেন বুড়ি! হয়তো তরীতেই ওঠে নাই। নাতির হিজরতের সুরাহা করে পেছন থেকে সরে পড়েছে।

শুরু থেকে তাই তো চেয়েছেন বিসমিল্লাহজান। বংশের একমাত্র বাতি মুসা- দমে দমে বলতেন সে কথা। দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সে বেঁচে থাকলে রক্তের ধারাটা তো বইবে। তাই তো হাড় জিরজিরে বৃদ্ধ শরীরটা টেনে টেনে পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙেছেন, জঙ্গল অতিক্রম করেছেন। এ দীর্ঘ যাত্রায় কখনো এনামেলের ভাতের হাঁড়িটা হাতছাড়া করেন নাই। পথে পথে শাকপাতা যা-ই হোক সিদ্ধ করে খেতে দিয়েছেন মুসাকে।
তখন এদিকে মন ছিল না মুসার। ওর নজর ছিল পথের ধারের পাহাড়ের দিকে, যদি আল্লাহর নূর দেখতে পাওয়া যায়, যে নূরে পাহাড় জ্বলে, মুসা জ্বলে না। কিন্তু এসব পাহাড়ের কোনোটির নাম তুর ছিল না। তবে পথে সে একটি লাঠি কুড়িয়ে পেয়েছিল। যার আগায় ঝুলিয়ে নিয়েছিল কাপড়ের পুঁটলি আর এনামেলের ভাতের হাঁড়িটা।
মুসাদের কাফেলা যখন নাফের তীরের বালুর চরে পৌঁছায়, তখন বালিতে বোঝা নামিয়ে লাঠিটা ভারমুক্ত করে সে। বালুর চর তখন কারবালা। পানির কষ্ট, খানার কষ্ট। নদী আর সাগরের মোহনার নোনা পানি খেয়ে বমি, কান্না, হেঁচড়-পেঁচড়। তার মধ্যে এক নারী বাচ্চা বিয়োলে নবজাতকের কানের কাছে আজান দিতে ডাক পড়ে মক্তবের তালেব আলেম মুসার। দু-দিন, দু-রাত। পারাপারের নৌকার দেখা নাই। পেছন থেকে তাড়া করছে ফেরাউনের বাহিনীর মতো বর্মি সেনা। তখন সবার অগোচরে মুসা একবার দরিয়ার দিকে হস্ত বিস্তার করেছিল। কাজ হয় নাই। তারপর রাত নামলে হাতের লাঠিটাই ছুড়ে মারে পানিতে। এবারও বিফল হয়। ¯্রােতের টানে অন্ধকারে ভেসে যায় সেই লাঠি। তখনই উল্টা দিক থেকে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভটভট শব্দ করে থামে এপারে। সেই নৌকায় বোঝাই হয়ে মুসা গতরাতে এই অচেনা মুলুকে পা দিয়েছে। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে দাদি বিসমিল্লাহ।
ফের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কোথায় উঠবে, কী খাবে দাদি! পোড়া ভিটা। পোড়া খেতি-কিষ্টি। শোনা যায়, ভিটেবাড়ি চষে সমান করে দিয়েছে হুকুমতের লোকজন। পারিবারিক কবরস্থানটা যদি আনাম থাকে, এর শিয়ালের গর্তে হয়তো ঠাঁই নেবে। দাদির আড়ে-ঠারে বলা কিছু কথা, এখন ক্ষুধা আর অনিদ্রাজনিত ঝিমঝিম করা অবশ মস্তিষ্কে মুসার যত দূর স্মরণ হয়, তাঁর মতলবটা সে রকমই ছিল। সেই গোরস্থানে বছর পাঁচেক আগে দাফন করা হয়েছে বিসমিল্লাহজানের একমাত্র পুত্র, মুসার বাবাকে। মুসা তখন ৮ বছরের বালক। সে গোরখোদকের মাটি কোপানো দেখতে দেখতে ভাবছিল, এখানে তার দাদা, দাদার বাবা-মা আরও ঊর্ধ্বতন বংশধরেরা শুয়ে আছে। বাবার জীবনটা খুব কষ্টে কেটেছে। মৃত্যুটা আরও কষ্টের। পয়লা হুকুমতের সেনারা বুকে গুলি করে। পরে গলা কাটে মগ ফুঙ্গিরা। কবরে শুয়ে বাবা সেই দুঃখের কথা বলবে তাঁর আপন মানুষদের, যাঁরা অপেক্ষাকৃত শান্তিতে জীবন কাটিয়ে গেছে।
মুসা চোখ মুছে বেড়িবাঁধের পাথরের ধাপে বসে। এখান থেকে পানি আরও কাছাকাছি। নাফ নদীর এ বাঁধে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ। সবার নজর নদীর ওপারে। রাত নামতেই নদীর বুকে জ্বলে ওঠে একটি-দুটি কেরোসিনের বাতি। তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ টর্চের আলোর ঝলক। তখন বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে মুসার। ব্যাটারির আলোটা কি হুকুমতের সৈন্যদের?


গত রাতের ফেলে আসা সেই বালুর চরে এখনো হয়তো ত্রিপল বিছিয়ে হাজার হাজার মানুষ এপারে আসার ইন্তেজার করছে। তার মধ্যে কেউ বাচ্চা বিয়োচ্ছে। মারা যাচ্ছে কেউ। শরীরে পোড়ার ক্ষত, গুলির জখম। দাওয়াই নেই, পথ্য নেই। দুনিয়ার বুকে এমন দোজখের আজাব কোন অপরাধে? দাদি কি এখনো বালুর চরের আজাবে দগ্ধ হচ্ছে?
ঘাটে ঝাঁকে ঝাঁকে নৌকা ভিড়তে মুসা বাঁধ থেকে লাফিয়ে পানিতে নামে। উল্টা দিক থেকে গলা পানি ঠেলে আসা মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে তার আগে-বাড়া সম্ভব হয় না। সঙ্গে বাতিও নাই যে শত শত লোকের ভিড়ে দাদির মুখটা আলাদা করে চিনে নেবে। এপারে যতটুকু আলো, সেসব ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, নয়তো এ মুলুকের হুকুমতের লোক-বিজিবির বা কোস্টগার্ডের টর্চলাইটের। তারা তীরে তোলা মোহাজিরদের প্লাস্টিকের বস্তা, রন্ধনের সামগ্রী, কলসি, নষ্ট দেয়াল ঘড়ি, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল আর কাঁথা-বালিশের স্তুপে টর্চ টিপে তল্লাশি চালাচ্ছে। সে সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মুসার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। যদি ঝড় উঠে মাঝদরিয়ায় ডুবে মরে দাদি! মুসা বুক-পানিতে থাকতেই মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে। তার মধ্যে নৌকা ভিড়ছে বিরামহীন আর সাগরের ঢেউয়ের মতোই অগুনতি। সঙ্গে পানির দাপাদাপি, ইঞ্জিনের কানফাটা গর্জন।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে বাঁধের কাছের এক বাড়ির গোয়ালে আশ্রয় নেয় মুসা। গোয়াল না বলে একে ছাগলের খোঁয়াড়ই বলা চলে। তা-ও বাড়ির একমাত্র কুঁড়েঘর-সংলগ্ন গোলপাতার ছাউনির চালা এটি। যার তিন দিকই খোলা। আর এ স্বল্প পরিসরের জায়গাটিতে দুটি দড়ি-বাঁধা ছাগল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। মুসাও এদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। এখন রাত কত কে জানে। বাড়ির মানুষগুলি তো মনে হয় ঘুমে কাদা। সে ভাবে, বৃষ্টিটা ধরে এলে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। তখন প্রচ- শব্দে বাজ পড়লে কাছের ছাগলটার গলা জড়িয়ে বসে পড়ে মুসা। অনেক দিন পর চেনা সেই স্পর্শ। গন্ধটাও অবিকল সে রকম। একটু পর বিদ্যুৎ চমকালে সে এই প্রথম অচেনা মুলুকের কোনো প্রাণীর দিকে চকিতে তাকায়। অপরিচিত কিছু মনে হয় না। বরং চোখ দুটি নিজের পোষা ছাগীর মতো মায়াবী লাগে। মুসা মক্তবের তালেব আলেম হলে কি হবে, আদতে তো ছিল রাখাল- এক জোড়া সোনালি রঙের মহিষ আর গোটা চারেক বাচ্চাসহ দুটি ছাগলের। ছাগলগুলি যখন আগুনে পুড়ে ছটফট করে মরছিল, তখন কত-না কষ্ট পেয়েছিল।
বাড়িতে হুকুমতের আগুন দেওয়ার দিন আগেভাগে মহিষ দুটির দড়ি কেটে দেওয়া হয়েছিল। আর বারো বছরের মুসাকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন দাদি। ভেবেছিলেন হয়তো বাড়িতে নারী-শিশু আর অবোধ কটা ছাগল, ওদের আর কী হবে। কিন্তু বিসমিল্লাহজানের জানা ছিল না, হুকুমতের জুলুম দিনে দিনে বেড়ে গেছে। কন্যারাও আর রেহাই পায় না। ধর্ষণ এ জালিমরা আগেও করত, এবার লোহু ঝরাতে শুরু করেছে। মুসা দুদিন পর বাড়ি ফিরে দেখে ছাই আর ভস্ম। সেদিনই আরেকটু দক্ষিণে দাদির বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওখানে কাটায় হিজরত করার আগের প্রায় টানা এক বছর।
মায়ের কথা ভাবলে মুসার মনে পড়ে, তিনি বাচ্চা কোলে বাড়ির উঠানের ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বাচ্চাটার কবুতরের মতো গোলাপি পায়ের পাতা মায়ের কোলের এক পাশ থেকে ঝুলে রয়েছে। এখন কই তার মাসুম ভাইবোনেরা? আর মা? নিজের কান্নায় ঘুম ভাঙে মুসার। দেখে সে ছাগলের খোঁয়াড়ে বিচালির ওপর কুঁঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে। পাশে সেই ছাগল জোড়া। আর কে যেন ছেঁড়া কাঁথায় তার সারা গা জড়িয়ে দিয়ে গেছে। যেমনটা মা ঘন বর্ষায় বা শীতের মৌসুমে মাঝরাতে নিঃশব্দে উঠে করতেন। তা সত্ত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগে খোঁয়াড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মুসা। বেড়িবাঁধের দিকে সে আর ফেরে না। কাদামাটির পথ ভেঙে উল্টা দিকে হাঁটতে শুরু করে।
সামনের বাজারটা খোদার বিহানেই গমগমে। দূরপাল্লার বাস থেকে শহরের সাহেব-সুবারা নামছে আর ব্যাগ কাঁধে ছুটছে চা-নাশতার দোকানের দিকে। ভোরের বাতাসে সুখাদ্যের ঘ্রাণ। তাতে মুসার চাপা-পড়া পেটের খিদেটা চাগিয়ে উঠলে সে দোকানের সামনে ঘুর ঘুর শুরু করে।
একজন খাবার দোকান থেকে বেরিয়ে মুসার দিকে ক্যামেরা ধরলে ও পাশের দোকানের শেডে আড়াল নেয়। ছবি তোলাটা ভড়ং, আসলে পাচারকারী- ভাবে মুসা। আর ভেতরে-ভেতরে ফুঁসতে থাকে সাপের মতো। সেই লোক ফের দোকানে ঢুকে খাবারের প্লেট হাতে বেরিয়ে কাছে ডাকলে মুসা পা ঘসটাতে ঘসটাতে এগিয়ে যায়। হামলে পড়ে খাবারের ওপর। এ অবস্থায় ক্যামেরায় কয়বার ক্লিক ক্লিক শব্দ তুলল, কতবার তার বুভুক্ষু চেহারার ফটো খিঁচলো, সে তা থোড়াই পরোয়া করে। খাবার শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে মুসা ভাবে, ছবি তুলতে দেওয়ার বিনিময়ে যদি দু-বেলা অন্ন জোটে তাই সই। বাস্তবিক সে এখন ইন্তেজার করছে এমন একটা ছড়ির, যা নিমেষে সর্পে পরিণত হবে।
জীবনের নিশানা মিলে যেতে খোলা মনে চারপাশে নজর বুলায় মুসা। জায়গাটা টাউনশিপ না হলেও জমজমাট একটি বাজারই বটে। পাকা দোকানপাট আছে কিছু। কাছাকাছি একটা স্কুলঘর, যার ঢালা বারান্দায় কাদামাখা মানুষ গাদাগাদি করে ঘুমাচ্ছে। মাঝে স্তুপ করে রাখা জঞ্জালসম সংসারের ছেঁড়া-খোঁড়া ময়লা সামগ্রী। এমন একটি ছিন্নমূল দলের প্লাস্টিকের বস্তার আড়াল থেকে যে উঠে আসে, তাকে দেখে মুসা দু-কদম পিছিয়ে যায়। ছেলেটা কি তার যমজ ভাই, না আয়নায় সে নিজেকে দেখছে? ফারাক শুধু ওর গালে সেনেকারের মতো সাদা বেলেমাটির ছোপ। আর পরনে হাঁটু-কাটা আকাশি জিন্স। এমন আরও কিছু বৈসাদৃশ্য নিয়ে ওরা যমজের মতো দোকানের সানশেডের নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। কারওরই যেন কথা কওয়ার বিন্দুমাত্র শক্তি বা ইচ্ছা নাই।
সেই ক্যামেরাম্যান স্থানীয় একজনকে বগলদাবা করে এগিয়ে এলে মুসা চট করে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এত আদেখলাপনা কেন লোকটার! ওর হাভাতে ভিখারিমার্কা গোছা গোছা ছবি তুলেও আশ মেটে নাই? কিন্তু ক্যামেরার ক্লিক নয় লোকটার কথা কানে যেতে মুসা বোঝে যে, এবার ইন্টারভিউ হচ্ছে। শুরুতে পাশের বালকও খামোশ। হয়তো বোবা, কালা। পরক্ষণে তোতলাতে শুরু করে। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে মুসার। আখেরি জমানায় কি সবকিছুই উল্টোপাল্টা? মুসার জিহ্বা অনাড়ষ্ট আর হারুন তোতলা? যদিও তার কওমের এ বালকের নাম হারুন কিনা সে জানে না।
‘এত হত্যা-ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও’ ক্যামেরাম্যানের কথা রোহিঙ্গা ভাষায় তর্জমা করে স্থানীয় লোকটা শুধায়, ‘এসব নিজের চোখে সে দেখেছে কি না?’
এ সওয়ালের জবাব কী? আর কীভাবে তা বলা যায়? পাশের বালক কি সাধ করে তোতলায়? মনে মনে খুব তোলপাড় হয় মুসার। সে যমজ ভাইয়ের মতো দেখতে বালকটির উদ্ধারে দেয়ালের ওপর থেকে মুখ সরায়। দাদির হাত ধরে ও ছুটছিল- রোহিঙ্গা ভাষায় গড়গড়িয়ে বলতে থাকে মুসা। পেছনে কালো ধোঁয়া আর আগুন, সঙ্গে চিৎকার আর গুলির শব্দ। রাস্তাজুড়ে লাশ আর লাশ। গুলিবিদ্ধ। গলাকাটা। তারপর সাগরের গর্জন। সাগরটা আর্তনাদ করে দু-ভাগ হয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু তার হাতের লাঠির সে ক্ষমতা ছিল না।
লোক দুটি ফেরাউনের মতোই মুসার কথাটা অবিশ্বাস করে। কিন্তু যমজ ভাইয়ের মতো বালকটি খুশি হয়। যদিও তার নাম হারুন নয়, শাহ আলম।
স্কুলঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শাহ আলম বলে, গতরাতে ওরা ভেলায় চড়ে এপারে এসেছে। এসেছে মংডুর ফাতংজা গ্রাম থেকে। শাহ আলমের বাবা নিখোঁজ, বড়ভাই খুন হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে আছে বাদবাকি তিন ভাইবোন।
‘মুসারে নিয়ে তোরা চারজন,’ বারান্দার মেঝেতে বসে প্লাস্টিকের মাদুর রোল করতে করতে শাহ আলমকে বলে তার মা। খানিকপর ট্রাক আসবে। চালান হবে ওরা কাছাকাছি কোনো রিফুইজি ক্যাম্পে। মুসার কেমন হাঁসফাঁস লাগে। বাতাসটা পানিভর্তি মশকের মতো ভেজা আর ভারী। আশপাশের লোকগুলিও যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটে। তাদের নিদ্রাহীন, ক্লান্ত চোখে ফাঁকা শূন্য দৃষ্টি। নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দ নাই কারও চোখে-মুখে। মুসারও কি চোখে-মুখে আনন্দ আছে? ক্যাম্পের পোকামাকড়ের জীবন সে কিছুতেই চায় না।
বাজারে ট্রাকের বহর থামতে মুসা প্রাণপণে উল্টা দিকে ছুট লাগায়। তাকে রে রে করে তেড়ে ধরে আনে এ মুলুকের হুকুমতের লোকজন। শাহ আলম ট্রাকে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষছিল। পাশে দাঁড়ানো ওর মা এমন সুরে বিলাপ জুড়ে দিয়েছিল যে, যেন তার পেটের বাচ্চা দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গরুর পালের মতো খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে রাগে গরগর করে মুসা। এ মুলুকের হুকুমতের লোকজনের চেয়ে শাহ আলমের মায়ের ওপর ওর রাগ হয় বেশি। মুসা পাতানো মা চায় না, ভাই চায় না, চায় একটা ছড়ি- যা নিমেষে সর্পে পরিণত হবে।
‘কেতাবের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে না রে মুসা।’ সেই রাতে বিসমিল্লাহজানকে স্বপ্নে দেখে মুসা। দাদি যেন বলছে, ‘এ মিলাতে যাওয়াটাই পুরাদস্তুর বোকামি। তুই আমার আশা ছেড়ে দে ভাই। তোর সারা জীবন সামনে, তুই একাই এগিয়ে যা।’
‘আমি কোথায় এগিয়ে যাব দাদি?’ মুসা অভিমানে কাঁদো কাঁদো হয়ে ধরা গলায় বলে, ‘আমি তো পেছনে ফিরতে চাই। সেই কবরস্থানে, যার শিয়ালের গর্তে গা ঢাকা দিতে তুমি এখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছ।’
ঘুমের মধ্যে কে একজন গুঙিয়ে উঠলে চুপ মেরে যায় মুসা। ত্রিপলের নিচে শুয়ে সে কুলকুলিয়ে ঘামতে থাকে। অনেক দিন পর পেটে আজ ভাত পড়েছে, ত্রাণের চালের ভাত। তা-ও হজম হয় নাই ঠিকমতো। তবে গতকাল একদিনেই দুরন্ত সব কাজ হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের মাথা গোনা, রেশনকার্ড। ত্রিপল-ঢাকা ঠাঁইয়ে রঙিন ব্যাগে করে রেশনের চাল-ডাল-চিনি-তেল এনে তুলেছে ওরা। শাহ আলমের মা সংসারও গুছিয়ে ফেলেছে তখন তখন। সে সংসারের মুসাও একজন, যে তাদের সঙ্গে একই ত্রিপলের নিচে শুয়ে এখন রাত গোজার করছে।
সকালে সংসারের কাজ বণ্টন হয়। রেশনের লাইনে দাঁড়াবে শাহ আলমের মা ও তার ভাইবোনেরা। জঙ্গল থেকে লাকড়ি আনা আর কল চেপে কলসিতে পানি ভরার কাজ মুসা আর শাহ আলমের। ‘দুজনে হাবিল-কাবিলের মতো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করিস না বাপ’- ওরা জঙ্গলের পথে পা বাড়ালে শাহ আলমের মা ত্রিপলের ফুঁটো দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘মুসা-হারুনের মতো ভাই ভাই হয়ে থাকিস।’
মুসা-হারুন নাম দুটি এক সঙ্গে উচ্চারিত হতে মুসার রক্ত আনন্দে নেচে ওঠে। শাহ আলমের মাকে তখনই মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে ওর। সেই ইচ্ছা দমন করে শাহ আলমের দিকে তাকিয়ে। এমন বোকা-হাঁদা! লাকড়ি টোকানো ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগবে বলে তো মনে হয় না। যাই হোক, জঙ্গলে যাওয়া মানে তো শুধু চুলা ধরানোর কাঠখড় কুড়ানোই নয়, শক্তপোক্ত একখানা ছড়িও জুটে যেতে পারে। আরও একটি সুখবর যে, ক্যাম্পে তাকে বন্দী থাকতে হচ্ছে না।
জঙ্গলে যাওয়া ছাড়াও ক্যাম্পের লোকজনের সঙ্গে মুসা কাছের টিলায় ওঠে, যখন শোনে যে, নাফের ওপারে ফের আগুন দিয়েছে বর্মি সেনা। তখন ওর কওমের লোকেরা আহাজারি করে, নারীরা বিলাপ করে বুক চাপড়ায়। ‘দাদির লাই আঁর মন জ্বলের’- মুসাও তাঁদের সঙ্গে গলা মেলায়। কখনো সুর করে কাঁদে, ‘দাদি ছাড়া আঁই কেনে বাইচ্চুম!’ কান্না শেষে ওর চোখ দুটিতে জ্বলে জ্বলে ওঠে আগুন।
নাফে নৌকাডুবির খবর এলে নদীর পাড়ে ছুটে যায় মুসা। কখনো যায় কাছাকাছি বেড়িবাঁধে। পাথরের স্ল্যাবে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। তখন তার হাতে থাকে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা গজারির লাঠি। লাঠি দিয়ে পানিতে ঘাই দিতে দিতে আপনমনে বিড়বিড় করে সে।
দুনিয়ার এ কেমন বিচার- তার কেউ থাকবে না, কিছুই থাকবে না! না বাবা-মা, ভাইবোন, না ঘর-ভিটা, জমি-জিরাত, দেশ-মাটি! সে কী দোষ করেছে? ক্যাম্পেই কেন তাকে জীবন কাটাতে হবে?
এখান থেকে বেরোনোর একটাই পথ খোলা- একদিন নদীর ধারে এক পাচারকারী মুসাকে বলে, সে সিন্দাবাদ নাবিকের মতো ভাগ্যপরীক্ষায় সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে। কাছের এক সৈকতে নৌকা বাঁধা। এ বাবদে তার পথের মাসুলও লাগবে না।
মুসা ভাগ্যের পরীক্ষা চায় না। নিজ মুলুকে ফিরতে চায়। তার দরকার এমন এক ছড়ি, যা নিমেষে সাপ হয়ে দুশমনকে তাড়া করবে। সে দেখতে চায়, দেশময় ছড়িয়ে পড়ছে অজস্র ব্যাঙ, উকুন, পঙ্গপাল- যাদের ভয়ে বর্মি সেনা আরাকান থেকে নিষ্ক্রান্ত হবে। নয়তো নদী দিয়ে পানির বদলে রক্তের ¯্রােত বইবে, যেমনি তার কওমের ওপর হুকুমতের জুলুমের দরুন পানি রক্তে পরিণত হয়েছিল।
নদীতে রক্তের স্্েরাত বহানো পছন্দ হয় জেহাদির। টিলার ওপর থেকে নাফের ওপারের আগুন-ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে জেহাদি মুসাকে বলে, ‘এ কাজের জন্য তোমাকে অবশ্যই অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে হবে। গজারির লাঠিতে কিছুতেই তা সম্ভব নয়।’
‘কে বলে এ শুধু গজারির লাঠি?’ জেরা করে মুসা। সে এমন এক ছড়ির কথা বোঝাতে চায়, যা নিমেষে সর্পে পরিণত হয়।
মুসার কথায় গোসসা হয় জেহাদির। বলে, ‘ শোনো হে মুসা, এটা আখেরি জমানা। গোলা-বন্দুকই এখন শেষ কথা।’
মুসার খুব অসহায় লাগে। সে কি এ দ-ে সামান্য মোজেজাও দেখাতে পারে না? যেমন ছোট্ট একটা ব্যাঙ? মুসা হাতের মুঠো খোলে। ব্যাঙের বদলে তার হাতের তালুতে তিরতির করে কাঁপে বাতাস।
কিন্তু যে দুটি পথ পাচারকারী আর জেহাদি বাতলাচ্ছে, তার কোনোটাই পছন্দ নয় ওর। তাহলে কী করবে? খুব কান্না পায় মুসার। সে রাগে-দুঃখে হাতের ছড়িটা ছুড়ে ফেলে। নিমেষে তা সর্পে পরিণত হয়ে টিলার ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে যায়।


হামীম কামরুল হক
সাক্ষাৎকার

আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
গল্পের শিল্প হলো বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে গল্পটিকে নিয়ে আসা।
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
ভাষা ও নির্মাণ। বিষয় যেকোনো কিছু হতে পারে। ভাষা ও নির্মাণই কোনো কিছুকে গল্প করে তোলে। ফলে এ দুয়ে বিশেষ প্রাধান্য দিই। তবে বিষয় অনন্য হলে তো ষোলআনা পূর্ণ। কমলকুমারের কেবল ভাষা ও নির্মাণ অনবদ্য নয়, বিষয়গুলিও অনবদ্য।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি একেবারে ঠিক করে রেখেছিলাম যে, একটি জাদুবাস্তববাদী গল্প লিখব। সেটা হলো কতটা হলো কে জানে, তবে এটাই আমি করতে চেয়েছিলাম।
নিরীক্ষা আসলে যেমন কমা দিয়ে দিয়ে লিখেছি। কোনো জায়গায় দাড়ি দাবি ছিল, কিন্তু সেটা মানিনি। এই যে মানলাম না, সেটা একটু ঝুঁকির। সেই সামান্য ঝুঁকিটাই নিতে চেয়েছি। একে নিরীক্ষা বলা যায় কি? মোট কথা প্রচলের বাইরে থাকতে চেয়েছি। ইচ্ছা করে। দৈনিক পত্রিকায় এ গল্প দিলে তারা কি এটা ছাপতে পারত? এ প্রশ্নটাও উঁকি দিয়ে গেছে।
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফর্ম ও স্টাইলই যদি না থাকলো তাহলে আর এখন গল্প লেখা কেন? এখন তো নারায়ণ গাঙ্গুলি কি সুনীল গাঙ্গুলিদের মতো গল্প লেখার দিন নয়। ফলে নতুন কিছু করা দরকার। বিষয়ে, আঙ্গিকে, স্টাইলে, আরো যত দিক আছে তা অত্যন্ত দরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
বাংলা গল্পে এ নিয়ে কি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে? হলে কিভাবে হয়েছে।
বাংলা গল্পে অনেক নিরীক্ষাই হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হাংরি, নিমসাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী। বাংলাদেশে ষাট ও আশির দশকে নানান নিরীক্ষা চোখে পড়ে। নব্বইয়ে সব মিশে গেছে। যদিও দশক ভেদে এসব বলার মুশকিলও আছে।
ভাষা, চরিত্র, বর্ণনা কত দিকে নিরীক্ষা হয়েছে। আমি যেমন একটা গল্প লিখেছিলাম। একটাও আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার না করে ভয়াবহ আপত্তিকর একটি গল্প লিখব। সেটা পড়ে অনেকেই তাই বলেছিলেন, যে সেটা সম্ভব করেছিলাম। আমাদের গুরুরা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, তারপর তিন বাড়ুজ্জে, সতীনাথ, সমরেশ বসু, পঞ্চাশ দশকের পশ্চিমবঙ্গে এক ঝাঁক লেখক, দেবেশ-সন্দীপন-শ্যামলরা তো মাতিয়ে দিয়েছেন। কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ তো আর কী বলব, নিত্য তাজা রেখেছেন বাংলা গল্পের পথ। অল্প কথায় বলা যাবে না। মিনি সাক্ষাৎকারে আর কী বলব?
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
না বিকাশ থেমে যায়নি। একটু ধীর হয়েছে। লেখালেখি একটা নৈতিক কাজ। তবে সুনীতি প্রচার বা ধর্মপ্রচারে মতো নীতির কাজ নয়। এটা ভালো মতো বোঝা দরকার। এটা নাস্তিক্য-আস্তিক্য বা দেশ উদ্ধারের জায়গাও না। সবার আগে এটা শিল্প হলো কিনা, তারপর বাদ বাকি বিচার।---আপাতত এটুকুই বলি। ধন্যবাদ।

বাস্তবের গলনাঙ্ক

পাঁচ টাকার কয়েনটা ঠিকমতো পকেটে রেখেছি তো, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকটি তার জিন্সের প্যান্টের পেছন থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেখবে, এবং সেটা সে দেখতে যাচ্ছিল এমন একটা জায়গায়, যেখানে একটা বাড়ির পেছন দিয়ে পায়ে চলার পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে, এখনকার কমিশনারের তৎপরতায় এই পথ এখন হাল ফ্যাশানের ইটের তৈরি, এগুলোকে সিরামিক ইট না টাইলসের মতো কিছু, কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না, যারা দিনের পর দিন এই পথ দিয়ে যাচ্ছে আসছে, তারাও জানে না, যদিও এই পথটা গেছে বস্তির দিকে এবং একটু জঙ্গলমতো আছে বলে, দিনের একটা সময় এটা নির্জন হয়ে যায়, সারাদিনেও তেমন কেউ এ পথে যায়-আসে না, তবে এ পথে শর্টকাট মারা যায় বলে কেউ কেউ সুযোগ বুঝে এ পথে আসে, আর আসে বস্তিতে নিষিদ্ধকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা বা নারীপুরুষ, নিষিদ্ধ মানে মাদক আর সুরত-সওদার কাজে, অবশ্য এই বাড়ির এই কোণটা আরো বেশি নির্জন হয়ে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানিকের জন্য, ঈদের ছুটির আগে-পরে এ দিকটাতে লোক প্রায় আসে না, আর সেজন্যই ঘটনার সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল, কয়েনটা তার ক’দিন আগে শাহ্বাগের ফুটপাতের দোকান থেকে কেনা মানিব্যাগের ভেতরে আরো একটা ছোট্ট ব্যাগ, চেইন লাগানো, তাতে রাখা ছিল, কিন্তু চেইনটা লাগানো হয়নি, তাই সেটা দেখতে গেলে, অসাবধানবশত বা তাড়াহুড়ার জন্য কয়েনটা ওই ফুটপাতে গড়িয়ে পড়ে, আর গড়িয়ে পড়ামাত্র সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক, মুখে একটা ‘ইস্’ ধরনের শব্দ করে গড়াতে থাকা কয়েকটার পেছনে ছোট্ট একটা দৌড় দেয়, আর সেই দৌড় তার মাত্রামতো যেখানে পৌঁছাতে পারত, তার আগেই কয়েনটা কাত হয়ে পড়ে যায়, আর ঠিক তখন, কয়েনটা তুলতে গেলে, সে দেখতে পায়, এক অসামান্য পা, ছুঁচালো পায়ের আঙুল, চাঁদের মতো সাদা নখের প্রান্ত, আর তাতে গোলাপের পাপড়ির রঙ, পায়ের আঙুল ও পায়ের গোলাপি আভা দেখে ওপর দিকে তাকাতে গিয়ে, শাড়িপড়া এক মালকিনের মুখে তার দৃষ্টি গিয়ে থামে এবং সে বুঝতে পারে, এমন সুন্দর মুখ ইহজগতে সে আর দেখে নাই, সেই সঙ্গে ভেসে আসা জুঁইফুলের গন্ধটাও সে চিনতে পারে, এবং সেই যে এক হাত কয়েন তুলতে আর ঘাড় উঁচু করে ওপর দিকে তাকানোর ভঙ্গি নিয়ে সে স্থির হয়ে যায়, এর সাত দিন পর, একজন মানুষ ওই পথে ওমন করে মাটিতে বসে থাকা তাকে দেখে প্রথমে ভয় পায়, পরে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিতে তার মনে হয়েছিল লোকটা না জানি শক্ত কাঠের মতো করে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকটি সংবিৎ ফিরে পায়, এবং তার মনে হয়, মাত্র মুহূর্তখানিক সে এমন করে ছিল, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়, কোথায় গেল নারীটা, তার চেহারা চোখে লেগে আছে, কেবল জুঁইফুলের গন্ধটা নাই, কিন্তু তার মনের ভেতরে তখন ওই জগতের সবচেয়ে সুন্দর পা ও সবচেয়ে সুন্দর মুখ দু’টো বারবার ফিরে আসতে থাকে, এই দ’ুটো ছবিকে মনের মধ্যে বারবার ডুবিয়ে ও ভাসিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে, এবং দেখে তার অসুস্থ মা বিছানায় প্রায় যায়যায় অবস্থা, সাত দিন ধরে এই বুড়ি বিছানায় পড়ে আছে, কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য তার মল বের হয়নি, কিন্তু তার মুতের গন্ধে গোটা ঘর ম ম করছে, যুবক মায়ের গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিলে বুড়ি খোনা গলায় বলে ওঠে, ও বাবা আইলি! কই ছিলি গত সাত দিন? আমার জান তো যায় যায়, কেবল চোখের সামনে ক্যালেন্ডারের দিতে তাকাইছি, আর ভাবছি, একদিন গেল, দুদিন গেল, তিন দিন গেল, চার দিন গেল, তোরও কোনো দিশা নাই, আর পরিনাও আসে না, পরিনারে ফোন করেছি, তারেও পাই না, এর ভিত্রে বিছানা নষ্ট করছি কয়েকবার, তারপর আর হুশ নাই, তখন যুবক বলে, কও কি মাও, সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, সে নিজেও তাহলে সাত দিন খায়নি, এই সাতদিন তার মোবাইল ফোনে কোনো ফোন আসেনি, সেটা মনে হতেই সে দেখে সে বন্ধ না করলেও মোবাইল ফোন


আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আছে, কীভাবে এটা ঘটল তা বুঝতে পারে না, সে বোঝা পরে বোঝা হবে, আগে মা বেটায় খেয়ে নেওয়া দরকার, কিন্তু তার আগে বিছানার চাদর আর মায়ের গাতো ধোয়ানো দরকার, মুতের গন্ধটা এবার ঝাঁঝালোভাবে নাকে লাগে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের ভীষণ রাগ হয়, মাকে দেখাশোনা করারজন্য রাখা পরিনাকে ডাক দেয়, পরিনাকে ফোন করে, তার ফোন বন্ধ পায়, পরিনা কই? হের তো কোনো খবর নাই, তারে কী আর কম ডাকছি, কত কইরা কইলাম, একটু খাইতে দেও, হেও তো উধাও! যুবক বলে, তাহলে কবে থেকে তুমি খাও নাই, খোনা গলায় বুড়ি উত্তর দেয়, শেষ যে পাশের বাড়ির কার দিক থেইক্যা কেক দিয়া গেল, জন্মদিন না কী ছিল, ওই ঢঙ্গি মাইয়াটার, যারে তুই নাকি সিনেমায় নামাবি, হেই দিন থেইকা, মাইয়াটা তো প্রায় দিনই আইত, তুই যে উধাও হইলি, হের পর তো অরও কোনো পাত্তা নাই, পরিনা নাই, তুই নাই, হে নাই, বুঝলাম না কিছু, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে, সেও টের পায়, তার সারা শরীর জুড়ে এক দানবীয় ক্ষুধা সাপের মতো ছোবল দিচ্ছে, পাগল হয়ে যাবে সে, সে বলে, মাও, আমি যাইতাছি, আর আইতাসি, বলেই সে দৌড়ে বের হয়, আগের সেই পথে নয়, বাড়ির সামনে দিয়ে, সে পঞ্চাশ গজখানিক সামনে এক হোটেলে যায়, ওখানে, গিয়ে
কাবুল মিয়াকে বলে, বলতে বলতে সে পকেট থেকে টাকা বের করে, মায়ের প্রিয় নানরুটি আর লটপটি দিতে বলে, কাবুল কয়, লটপটির দিন কি আইজ? গিলা-কলিজা কি একলগে পাওয়া যায়? কদিন জমলে তো তা দিয়ে লটপটি, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের তখন সময় নাই, যা আছে দেন তাড়াতাড়ি, কাবুল বলে, ডালভাজি, পরোটা আর ডিমভাজি দেওয়া যাবে, চলবে? সে বলে দৌড়াবে, চার পরোটার দুইটা ডিম আর দশটাকার ডালভাজি, কাবুল তখন তিনটা আইটেমের নাম ও পরিমাণ বলে হাক দেয়, চার পরোটার দুইটা ডিম আর দশটাকার ডালভাজি পার্সেল, এমনিতে পুরো জিনিস পাওয়ার পর যুবক বিল মেটায়, কিন্তু আজ আগেই মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়েছিল, ফের ওই মেয়েটার কথা আবার মনে হু হু করে জেগে ওঠে, মেয়ে না নারী, আহা কী গায়ের রঙ, কী মুখের আদল, কী রূপ, কত নায়িকাকে তো দেখল, কিন্তু এমন একজনও তো এর তুলনায় মেলে না, এক ডিরেক্টর কইছিল, আসল নায়িকারা কখনো সিনেমায় আসে না, যাদের জীবন নিয়ে সিনেমা হয়, তারা থাকে সমাজের ভেতরে মিশে, যেমন যারা গল্প উপন্যাস গরিব মানুষদের নিয়ে লেখে, তারা জানে ক’জন গরিব মানুষ গল্প উপন্যাস পড়ছে, অবশ্য এ নিয়ে তর্ক হতে পারে, এ তর্ক করতে গেলে আমরা এই সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের অনুভূতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারব না, এই যে মানিব্যাগ বের করছে, তখন সে ফের সুগন্ধ পায়, ঠিক কাবুল মিয়ার দোকানের পাশ দিয়ে একটা মোটর সাইকেল যায়, তাতে বসে থাকা নারীটি, যে কিনা পুরুষ মানুষের মতো দু’পাশে দু’পা রেখে মোটর সাইকেলে বসেছে, আজ তার পরনে নীলজিন্সের প্যান্ট, আর ফতুয়া, খোঁপাটা চূড়া করে মাথার ওপরে বাঁধা, সেখান থেকেই গন্ধটা আসে, সে মোটরসাইকেলের নম্বর পড়ার সময় পায় না, হুস করেই গলির মোড়ে উধাও হয় সেই মোটরসাইকেল, তখন ফের সে বর্তমানে আসে, ততক্ষণে পার্সেলটা হয়ে গেছে, সে পার্সেল নিয়ে এক দৌড়ে বাসায় ফিরে আসে, এসে দরজা খুলে বিছানায় চোখ যেতেই দেখে বিছানা ফাঁকা, কী ব্যাপার, মাও ও মাও, তখন খোনা গলায় ডাক আসে, বাবারে, আমি আওয়াজের আন্দাজ করে সে দেখে মা, কাঁথা দ’ুপাশে ঝুলে আছে, আর মা ভাসছে একেবারে ছাদের গা ঘেঁষে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের চোখ তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, মা ও মা, সে আর্তনাদ করে ওঠে, তার হাত থেকে পার্সেলটা পড়ে যেত আরেকটু হলে, সে হঠাৎ মনে করে মাকে জ্বিনে আছর করেছে কিনা, সে সঙ্গে আরো সতর্ক হয়ে ওঠে, কোনোভাবেই ভয় পাওয়া যাবে না, এমন একটা জিদও তার তৈরি হতে থাকে, মা ছাড়া এই দুনিয়ার তার কেউ নাই, কত মেয়ের সঙ্গে সে কত কিছু করছে, কিন্তু বিয়ে করতে ভয় পায়, কেবল মনে হয়, মাকে যদি বৌ কষ্ট দেয়, তো সেই বৌকে সে খুনই করে ফেলবে, মায়ের প্রতি এই ভক্তি তার কেন হলো, সে জানে না, মা তাকে কতটা ভালোবাসে তাও জানে না, মা তো ভালোবাসে তার একমাত্র মেয়ে জরিনাকে, জরিনার স্বামীর একটা রিক্সাগ্যারেজ আছে, জরিনা সুন্দর যতটা ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল চটকদার, মহল্লায় সবচেয়ে সেক্সি মেয়ে বলে তাকে পোলাপানের মনে হতো, জরিনা বরং নায়িকা হতে গিয়ে পারেনি, কিন্তু সে তার ভাইকে সিনেমার জগতে রেখে চলে এসেছে, জরিনা এখন থাকে শনির আখড়া, সেখানে তার স্বামীর পাঁচতলা বাড়ি, বিয়ে হয়েছে ছয় বছরও না, কিন্তু এর ভেতরে তিনটা ছেলে-মেয়ের মা হয়ে গেছে, বয়সকালে মাইয়া মানুষের গর্ভ খালি রাখতে নাই, এই ছবক তার স্বামী মোখলেস কোথায় পেয়েছিল, কে জানে, তবে মোখলেস সাটাতে পারে, সাটাতে পারে যেমন লালপানি, তেমন বৌকে, যেদিন ধরে,

সারারাতে ছাড়ে না, ফলে জরিনাও আহ্লাদে ডগমগ হয়ে তাকে সঙ্গ দেয়, কিন্তু মোখলেসের সব কিছু যেন ভাগভাগ করা, এক কাজে আরেক কাজ ঢুকে পড়ে না, একটা ধরে তো সেটা নিয়েই থাকে, কাজগুলিরে বগি বগি কইরা ভাগ কইরা লইছি, বুঝলানি, টেরেনের কমপার্টমেন্টের মতো, জীবন হচ্ছে টেরেন, আর কাজ হচ্ছে বগি বগি ভাগ করা, এজন্য সপ্তাহে টানা দু’দিন সে ছেলেমেয়ের বৌয়ের জন্য রাখে, ল জরি, তোর সারা সপ্তার খোরাকি ল, বলে জরিকে যেমন সেটা হাতে ভরে টাকা দেয়, যখন সে জরির শরীরে ভর করে, জরির শরীরটাও সে ভরিয়ে দেয়, তেমনই দিয়েছে গা ভরে গয়না, আর দিনরাত তো টিভি চলছে, সিনেমা চলছে, জরি আর বাংলা ছবিই দেখে না, দেখলেই তার মন খারাপ হয়, এমন পপি, শাবনূর, অপুতো সে নিজেই হতে পারত, কী কম আছিল তার, হিন্দি দেখতে দেখতে নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে হিন্দি বলে, মেরে পাস আ বাপ, ছেলে উত্তর দেয়, নেহি আউঙ্গা, তুম কিউ মুঝছে পুচতা থা, ভুলভাল ঠিকশুদ্ধ চলতে থাকে মা-ছেলের আলাপ, মাঝে মাঝে সিনেমায় টুকটাক কাজ করা ভাইটা এসে, বোন ও ভাগ্নের বাতচিতে ব্যাপক বিনোদন পেয়ে যায়, জরির সারাদিন মুখ চলতে থাকে, কী জরি কী হয়ে গেছে, আগের সেই একমুঠি কোমর আর তার নিচে বিশাল ঘড়ার মতো পেছনটা এখন মিলে গেছে, বিশাল আকৃতির কোলবালিশের ধড়ের ওপরে জরির ছোট্ট সুন্দর মাথাটা, তবে দীঘলচুল আছে জরির, জরির মতো সুন্দর না হলেও তাদের প্রোডাকশনে হীরামনকে বড়ই মনে ধরে আছে যুবকের, প্রথম দিকে নায়িকা করবে বলে, ভালোমতো কায়দা করেছিল বেশ কয়েকদিন, হীরামনের কোমরটা দু’হাতের দু’পাশ দিয়ে ধরলে তর্জনি আর বুড়ো আঙুলে মধ্যে মাত্র কয়েক পাঁচ কি ছ-আঙুল ব্যবধান থাকে, আর তেমন হলো তার পেছনটা, কিন্তু বুকটা বলতে গেলে প্রায় সমান, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক আগেও দেখেছে, যাদের পেছনাটা বেশ ভারি, বুক তাদের
গাওগেরামের ফসলি জমির মতো সমতল, দুটোই যাদের ভারি তারা আবার আকারে ছোটখাটো গাট্টাগুট্টা, একটাকে পেয়েছিল এমন, মেয়েটার ছিল কটা চোখ, আর গালটা গুটিবসন্ত সেরে যাওয়ার পরের দশা, খাদাখাদা মুখ, যা সুন্দর চুমু খেতে পারত, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবককে এমনিতে কারো অপছন্দ হবে না, লম্বা আর ছিপছিপে, শান্ত মায়াময় মুখ, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অভিনয়টা সে করেই উঠতে পারল না, কিন্তু সিনেমা থেকে সরেও যেতে পারল না, মনে মনে গোপন ইচ্ছা, সে একদিন নিজেই সিনেমা ডিরেক্টর হবে, কিন্তু প্রডিউসার জোগাড় হলো না, তার ডিরেক্টর বলে, ভালো গল্প পাই না, বুঝলা, সিনেমা হবে টাসকি খাওয়ার মতো, হলে ঢুকবো, মাগার আর নড়তে পারব না, এখন সেই কাহিনি যুবকের চোখের সামনে, মাকে ওমন ভাসতে দেখে, সে নিজেকে শান্ত করে, ঘরের একমাত্র টেবিলটা টেনে এসে মা যেখানে ভাসছে, সে জায়গাটায় আনে, তারপর আস্তেআস্তে টেবিলে ওঠে, টেবিলে তো মাথা নিচু করে উঠতে হয়, যে কোনো উঁচুতে উঠতে গেলে মাথাটা মাঝে মাঝেই নিচু করতে হয়, সেও এই উঠতে গিয়ে মাথা নিচু করে যখন মাথা খাড়া করবে, তখন দেখে, মা আর ওপরে নাই, ঘরের প্রতিটি কোণে চোখ দিশেহারা হয়ে দৃষ্টি ফেলে, মাও মা, মা!, তখন আবার খোনা গলায় ডাক আসে, এইহানে বাবা, এবার সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে, সে আর বুড়ি নাই, সেই ছোটবেলায় দেখা সুন্দর মা হয়ে গেছে, যেমনটা ছিল কিশোরী জরি, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের বাপ কাঠমিস্ত্রি ছিল, ছোটবেলায় ছোট একটা ঘরে তারা থাকতো, বাপ-মা আর তারা দুই ভাইবোন, অনেক রাতে বাপ ফিরত, তারপর অন্ধকারে ভেতরে কাপড়ের খসখস, চাপা গোঙানি, দিনের পর দিন টের পেয়েছে, মরার আগে বাপ কী করে কী করে যেন এই পৌনে এককাঠা জায়গায় দ’ুটো রুমওয়ালা একটা বাড়ি তুলে গিয়েছিল, আর আগে সামনে একই মাপে একটু ফাঁকা জায়গা মতো ছিল, সেখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনটা ছোট ছোট ঘর তুলেছে, একটা কলপাড়, একটা রান্নাঘর, একটা গোসলখানা আর একটা পায়খানা বানিয়ে দিয়েছে এই সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক, এইটুকু আছে বলে চালিয়ে নিতে পারছে জীবন, তারপরও বৌ আনতে সাহস হয় না, সুন্দর প্রাণচাঙ্গা করা, সোজা কথায় চার্মিং মাইয়া ছাড়া সে বিয়ে করবে না, অন্য দিকে সেই বৌকে তার মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, এই দুই শর্ত কোনো তালেই খাপ খায় না, একটা জিনিস আরেকটার ভেতরে ঢোকে না, যদিও জানে, সবদিকে সেরা তেমন বৌ কেউ কোনো কালে পাইনি, এমন কি চেহারায়ও, নাকটা সুন্দর তো ঠোঁটটা কেমন যেন, ঠোঁট সুন্দর তো কপালটা কেমন যেন, চোখ নাক মুখ সব সুন্দর কিন্তু চুল নেই ততটা দীঘল বা গালে ব্রন বা মেছতা, এই রকম একটা না একটা দিকে খুঁত থেকেই যায়, খুঁতওয়ালা গরু যেমন কোরবানি দেওয়া যায় না, খুঁতওয়ালা কোনো কিছুর জন্য নিজের কোরবান হওয়া মানায় না, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের এই দ্বিধাদ্বন্দ¦ কাটে না বলে অস্থায়ী বা মৌসুমী কিছু সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, আর সবই টাকা বা স্বার্থের বিনিময়ে, কিন্তু কোথায় যেন একটা না পাওয়া কাজ করে, কী যেন নেই কী যেন নেইÑ এমন মনে হয়, যখন যে জায়গায় যেটা পাওয়ার কথা সেটা সে জায়গায় নেই, এই বিছানায় পড়ে থাকা মায়ের ব্যাপারটা, মা মরে গেলে তার অনেক চিন্তা থেকে তার রক্ষা হয়, কিন্তু মায়ের জন্য যে মহিলাকে রেখেছে দেখা শোনা করার জন্য, তারও কোনো খবর নেই কেন, মেয়েটাকে মোবাইল পর্যন্ত কিনে দিয়েছে, পরিনার কোনো খোঁজ নেই কেন? পরিনার কাজ হলো মাকে বিছানা থেকে তুলে পায়খানা বা বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, ঘরের কাজের মানুষের আলাদা খরচ বলে, সব কাজ যুবকই করে যায়, পরিনাকে কাজ দিয়েছে কারণ মেয়েটা খুব টিপটপ, গায়ের রঙ মাজামাজা, আর চোখনাকমুখ খুব ধারালো, কিন্তু কথায় বার্তায় বড়ই নরম, এসব কথাও তার মনে জাগে না, সে কেবল তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় বিছানায় পড়ে থাকা আর দেখতে কিশোরী হয়ে যাওয়া কিন্তু গলা দিয়ে খোনা আওয়াজ বের হওয়া মায়ের দিকে, টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো সেই রকম ভয় পাবে কিনা বুঝতে পারে না, কারণ ভয় জিনিসটা সে আসলে পায় না, তার জীবনে ভয় পাওয়ার চেয়ে বিস্ময়ই বড়, অবাক হয়ে যায় ভয় পাওয়া মতো কিছু দেখলে, ঠিক বুঝতে পারে না এই সময় কী করা দরকার, সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছে: পপির মতো পূর্ণিমার মতো নায়িকাদের, যাদের কেউ কেউ ভয়ংকর সুন্দর বলে, দেখলে গা ছমছম করে কারো কারো, এও শুনেছে, তার এসব হয় না, বড় জোর থমকে যায়, চমকে ওঠে, আজকেও সে ভয় পায় না, বলে, মা ও মা আমি কি ভুল দেখতাছি, তুমি কি পুরাই ঠিক আছো? মা, ও মা, বাপজান আয় তুই আমারে বিছানা থেইকা তোল, আমারে কিছু খাইতে দে, কিশোরী হয়ে যাওয়া মায়ের এ কথায় যুবক হঠাৎ বিচলিত বোধ করে, সে প্রায় লাফিরে টেবিল থেকে নামে, আর তখন, বাড়ির দরজায় হৈ চৈ শোনা যায়, সে কিছু বোঝার আগে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সেই লোকটা, যে লোকটা তাকে ঠেলা মেরে সংবিৎ ফিরিয়ে দিয়েছিল, লোকটাকে তার ঠিক মনেও নাই, আর তার পেছন পেছন সেই মেয়েটি, যাকে দেখে সাত দিন সে মূর্তি হয়ে গিয়েছিল, এই লোকটাই তো ওই রাস্তা থেকে আপনার আংটিটা তুলছে, তুইলা পকেটে ঢুকাইছে, যুবক বলে, কীসের আংটি? কে পকেটে কী ঢুকাইছে? মেয়েটা ঘরে ঢুকেই বলে, এই কি সেই লোকটা? মেয়েটার পেছনে আরো কিছু লোক, প্রত্যেকেরই চেহারায় মারদাঙা ব্যাপার আছে, সিনেমায় ভিলেনের সঙ্গে এমন লোক থাকে, যুবক ঠিক বুঝতে পারে না, এখন যা ঘটছে তা সত্যি সত্যি ঘটছে, নাকি কোনো সিনেমার শুটিংয়ে সে আছে, কিন্তু তার তো কোনো অভিনয় করা যোগ্যতা নেই, তাই এটা সত্যি সত্যি ঘটছে, যা সত্যিই ঘটছে, তা তো সিনেমা না, সিনেমা কী আর কী সিনেমা না, সে তার নিজের মতো জানে, প্রোডাকশনে

সে টুকটাক কাজ করে, ততক্ষণে লোকটা বলে যাচ্ছে, সেই একই কথা, আমি দেখলাম ওরে রাস্তা থেইকা জিনিসটা কুড়ায়া নিয়া পকেটে ঢুকাইছে, এবার মেয়েটার দিকে হা করে সে আর তাকাতে পারে না, এবারও সে ভয় পায় না, এবারও সে অবাক হয়ে যায়, মেয়েটাকে সেদিনের মতো সুন্দরও লাগে না, কেবল বলে, আমার মা সাত দিন ধইরা অসুস্থ, তার ব্যবস্থা করতে হইব, হসপিটালে লইতে হইব, তখন অন্যরা হল্লা করে বলে, কোথায় তোর মা, তোর মা ঘরের মধ্যে মটকা মাইরা পইড়া ছিল, এরপর এলাকার লোকজন তারে ধইরা নিয়া কমিউনিটি হাসপাতালে দিয়া আইছে, হালায় কি চোখের মাথা খাইছস? যুবক তখন বিছানায় দেখে, তার কিশোরী হয়ে যাওয়া মা, কি একটা রহস্যময় কারণে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, সে সবাইকে বিছানার দিকে আঙুল তুলে বলে, ওই যে আমার মা, লোকদের ভেতরে একজন বলে, হালায় পুরাই গেছে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক তখনও মাকে ওই কিশোরী দশায় দেখছে, যাকে অন্যরা কেউ দেখতে পাচ্ছে না, এর ভেতরে হঠাৎ পরিনা ঘরে এসে, এত লোক দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়, সে সবার দিকে, আর সবাই পরিনার দিকে তাকাতে থাকে, সে কেবল বলতে পারে, যুবকের নাম ধরে ভাই যোগ করে, সে কোনো মতে একটা দুঃসংবাদ দেয়, যুবক তখন একটাই কথা এত জোরে বলে ওঠে, নাআআআআআঅ, আমি বিশ্বাস করি না! সেই চিৎকারে ঘরের ভেতরে থাকা সবার কান ফেটে রক্ত বের হয়, সবাই কাটা গাছের মতো ধুপধাপ করে ডানেবামে একে অন্যের শরীরে ওপর পড়ে যায়, আর যুবক পড়ে থাকা মানুষগুলিকে পাড়া দিয়ে ঘরের বাইরে এসে পড়ে, সে যে ওই হতবাক হয়ে সাত দিন মূর্তি হয়ে গিয়েছিল যে মেয়ের দিকে, তাকে এতটুকু খেয়াল না করে, তার বুকে পাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসে, সারা দুনিয়া তার কাছে একটা পাতালের সুড়ঙ্গ হয়ে ওঠে, কারো দিকে তাকানো কোনো কথাই আর তার বিবেচনায় থাকে না, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক ঊর্ধ্বশ্বাসে গলিপথ দিয়ে ছুটতে থাকে।

হামিম কামাল
সাক্ষাৎকার
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
আমার মনে হয়, গল্পের শিল্প তার উদ্দেশ্যহীনতায়।
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
আমি সামান্য মানুষ। ‘গল্প’ লেখার ক্ষেত্রে আমি গল্পকে প্রাধান্য দিই।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
সত্যি বলতে কী, ব্যাপারগুলো আমার নিজের কাছেও ঠিক ব্যাখ্যা করার মতো স্পষ্ট নয়। তবে, আমার কিছু ব্যক্তিগত দার্শনিক বোঝাপড়াকে গল্পের আকার দিতে চেয়েছি, এটুকু বলতে পারি।
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফর্ম, স্টাইল এসবকে স্রেফ টুলস হিসেবে দেখি, আর কিছু না। আর টুলস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তো বটেই। লেখক হলেন মুক্ত ইচ্ছার মনু। তার সংহিতা পরিবর্তনশীল। তার নিরীক্ষার ‘কিভাবে’ ওই ব্যক্তিগত মনুসংহিতার নির্দেশনায় বাঁধা। অগণিত মৌলিক ‘কিভাবে’ কে একটা সাধারণ পাটাতনে দাঁড় করিয়ে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
তবে; গল্পের আত্মার সঙ্গে যার বোঝাপড়া ভালো তিনি হয়ত আগে আলাপটা সেরে নিয়েছেন। যে, ‘বন্ধু, তুমি তো এমন, তোমাতে অমন প্রয়োগি?’ আত্মা বলেছে, ‘বেশ তো!’
আর যাদের বোঝাপড়া ভালো না, তারা গল্পের সঙ্গে টুলসবাজি করতে যাওয়ামাত্র গল্প তাদের ডিভোর্স দিয়েছে।
নিরীক্ষা সফল বা ব্যর্থ হয় ‘কিভাবে’, তার কোনো সূত্র হয়ত এতে আছে।
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বিনীত; যতদিন করোটির ভেতর বস্তু থাকবে, বস্তুর ভেতর ধূসর অংশ থাকবে, ততদিন শুধু গল্প কেন, শিল্পের একটা মাধ্যমেরও বিকাশ ‘একটি পর্যায়ে এসে’ থেমে যাওয়ার কোনো সার্বিক সম্ভাবনা নেই।

ফাঁদ

বৃদ্ধ বলল, ‘কী, কোনো শব্দ কানে আসে? পুলিশ লাইন তো খুব বেশি দূরে না।’ তার চোখে কৌতুক। দূরে ছাড়া ছাড়া গুলির শব্দ। আর থেকে থেকেই অনেক মানুষের স্বর। এই শোনা যায়, এই দূরে সরে যায়।
তরুণী শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো বৃদ্ধের প্রশ্নের। ‘আসেই তো। তোমার আসছে না বুঝি!’
বৃদ্ধ মুখে চুপ, চোখে নয়। ছাদ থেকে মেঝে সবখানে তার কৌতুকী চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনোভাব আড়াল করার কোনো ভদ্রতাসূচক চেষ্টাও তার নেই।
মেয়েটা বলল, ‘আসছে না তার মানে। অবশ্য আসার কথাও নয়। এতো বছরের অনভ্যাস। সেই কাঁচা চুলের কালে একবার দু’বার শুনেছ। এখন তো পাকা চুলের কাল।’
বৃদ্ধ হাত তুলে বলল, ‘যদি শুনতেই পেয়ে থাকো তো আর বাগাড়ম্বর কেন? চলো বেরিয়ে পড়ি, লোককে বলি। লোকবল ছাড়া তো আর বিপ্লব হয় না।
অবশ্য ঘুমানোর রাত এখনো পুরাটাই বাকি। তোমার বিপ্লবীরা সবে মাত্র বিছানায় গেছে সবাই। ডাক শুনে ক্ষেপে যাবে। কেউ কেউ মাথা যদি তোলেও, ভাববে কোনো স্বপ্ন বুঝি। একটা মুহূর্ত, ব্যাস! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়বে।’
‘তুমি দেখছি সেই তখন থেকেই...’ কথা শেষ না করেই থামল মেয়েটা। সামলে নিয়ে বলল, ‘কাজটা ভালোই পারো বোধহয়।


তা খোঁচা বুড়ো? তুমি তো আর শব্দটা শুনতে পারছ না, আসছে না তোমার কানে। তাহলে এক আমাকে বেরোতে উসকে দিচ্ছো কেন? তোমার রহস্যটা পরিষ্কার করো তো? আমার কেমন গোলমেলে ঠেকছে।
তুমি উভচর নও তো? যাকে বলে ডাবল এজেন্ট?
যদি হও তো হিসেবটা মেলে। আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে হাওয়া বুঝে ধরিয়ে দিতে চাও।’
‘এসব ক্লিশে মেরো না। জমছে না তোমার কৌতুক,’ বলল বৃদ্ধ।
‘তোমারও নয়। কৌতুকে রস থাকে বলে জানি। তা আমোদের রসই থাকুক, কি করুণ রস। তোমারটায় বিষ ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লো। বিষও তরল হয়, কিন্তু তা নিশ্চয়ই রস নয়! তোমার কৌতুকটা ওই বিষে আক্রান্ত হয়ে নিজেই মরছে।
আচ্ছা, এই তুমি এ ঘরে এসেছ কী কেবল আমাকে দুর্বল ক’রে দিতে? তোমরা কেন কেবল বয়োঃবৃদ্ধই হলে? কেন বিদ্যাবৃদ্ধ হলে না? কী ক্ষতি ছিল?
তোমরা তো সীসা দিয়ে, ইস্পাত দিয়ে বিপ্লব করেছ; এজন্যেই তোমাদের মনে এতো হতাশা! কারণ, তোমরা কাজের ফলটা পেয়েছ হাতেনাতে এবং ভেবেছ- আহ! এই তো পাওয়া গেল! কিন্তু দেখো, ওই ফল হাত থেকে খসে পড়ে গেছে। ওই ফল অন্য পাখি এসে ঠুকরে খেয়ে গেছে। ফল কি থাকে কখনো? কর্মফল সবসময় ক্ষয় হয়। অক্ষয় হলো ফলের ধারণা।
কী, ভুল বলেছি? আমার কথা ভুল হলে পাল্টা কথা বলো। প্রতিযুক্তি দাও।
বৃদ্ধের হাসি থেকে কৌতুকের চিহ্ন মুছে গেল। লেগেছে।
এমন সময় ছাদের এক কোণ থেকে একটা কালো মেঘ ধীরে এগিয়ে এলো একেবারে ঘরের মধ্যখানে। মেঘের ভেতর ছোট ছোট বজ্র, নিজেদের ভেতর যেন খেলছে। এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে ঝরতে থাকল জল। বৃদ্ধের মাথার ওপর।
বৃদ্ধ সরে দাঁড়ালে মেঘও জায়গা বদল করে। ঠিক তার মাথার ওপরটাই বেছে নেয় বারবার।
বৃদ্ধ অসহায় মুখ করে মেয়েটার দিকে তাকাল।
মেয়ে : ‘ভালো কথা। এই ঘরে তুমি কী করে এলে এ ব্যাপারে কিছু জানো?’
বৃদ্ধ : ‘আমি নিজেকে তো এ ঘরেই আবিষ্কার করেছি। এর আগের ব্যাপারে তো কিছু জানি না। তুমি জানো? তুমি এখানে এলে কী করে তা বলো। দেখি, সেখানে আমার উত্তরটাও আছে কিনা।’
মেয়েটা বলল, ‘আমিও নিজেকে এ ঘরেই আবিষ্কার করেছি। হঠাৎ।’
‘তুমি কি আমার মাথার ওপর মেঘটা দেখতে পারছ?’ বৃদ্ধ প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, পারছি তো।’
‘তাহলে সরিয়ে দিচ্ছো না কেন!’
‘বেশ,’ বলে মেয়েটা এগিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা ঝুলঝাড়–র দিকে এগোতে থাকল।
বৃদ্ধ খানিকটা ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘শব্দটা আমিও শুনেছি আসলে। তোমাকে উসকে দিতে চাইছিলাম, ঠিকই বলেছ। কিন্তু তাই বলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে কখনও না। তোমাকে ধরিয়ে দিলে আমি থাকব? আমারও যৌবন ছিল বিশ^াসের।’
মেয়েটা ঝুলঝাড়– হাতে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বৃদ্ধের মাথার ওপর থেকে মেঘটা সরিয়ে ধীরে ধীরে জানালার দিকে সেটিকে ঠেলে এগোতে থাকল।
জানালাটা বাইরে থেকে বন্ধ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। বলল, ‘ওহ, আমি তো ভুলেই গেছি, জানালাটা বাইরে থেকে ওরা বন্ধ করে রেখেছে।’
তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোয়ালে দুয়ার রুদ্ধ। ব্যর্থ শ^াপদ হানা দিয়ে ফেরে রাতের শিকারি ক্রুদ্ধ। ও তাহলে ঘরের ভেতরই থাক।’
‘আমার তো অসুবিধা নাই।’ বৃদ্ধ বলল। ‘মাথার ওপর না এলেই হলো।’
মেয়েটা জানালার ওপর ছাদের কাছে এক কোণে তুলে দিলো মেঘের স্তূপকে। অদৃশ্য হয়েছে মেঘের ভেতর আলোর চাবুক। জলপতনও বন্ধ হয়েছে।


মেয়েটা ঘরের মাঝখানে পেতে রাখা চেয়ারের ওপর গিয়ে বসল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এবার আমি আমার নিয়মিত আরাধনায় বসলাম। তুমি নিজের মতো সময় কাটাও। ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।’
‘আরাধনা? কার আরাধনা আবার!’ বৃদ্ধ বিস্মিত।
‘কালের আরাধনা।’
‘কাল? এসব... শিখলে কোথায়!’ বৃদ্ধ যেন খুবই অবাক হয়েছে।
‘আরাধনা তো শেখার কিছু নয় লো। শোনো-
একই পৃথিবীতে বাস করলেও সবার ভেতরেই একেকটা আলাদা পৃথিবী তৈরি আছে, একেকটা আলাদা লোক, একেকটা আলাদা জগৎ। তাই দেখো, মানুষ বোঝাতে এই তুমি বহুবার বলেছ, লোক। প্রতিটা আলাদা আলাদা জগতের সঙ্গে আলাদা আলাদা সময় জড়ানো। স্থান আর কাল জড়ানো। কোনো লোককে ধ্বংস করা হলে ওই লোকের লোক ধ্বংস হয় মানে কালও ধ্বংস হয়। এবার নিজ বুকে হাত রেখে দেখো, তুমিও একজন মানুষ, তুমিও আস্ত একটি লোক। সুতরাং তোমার ভেতরও আছে কাল।
কালের আরাধনা মানে কিন্তু প্রকারান্তরে নিজের ভেতরের ওই লোকের আরাধনা। তাহলে কী দাঁড়াল?’
ঘরের এক কোণে একটা চাঁদকে ভাসতে দেখল বৃদ্ধ। চাঁদটা যেন জলের ওপর ভাসতে থাকা শোলার নৌকা। ধীরে ধীরে অল্প খানিক জায়গার ভেতর ওঠানামা করতে থাকল।
‘হ্যাঁ? খুব কঠিন করে কথা বলো তুমি।’ বৃদ্ধ বলল।
মেয়েটা বলল, ‘অথচ গোটা পৃথিবীতে কিন্তু তরুণরাই উল্টো বৃদ্ধদের এ কথা বলে। বলে, বড় কঠিন করে কথা বলেন তো আপনি! একটু সহজ করে বলতে পারেন না?’
বৃদ্ধ চুপ করে থেকে খানিক বাদে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমিও কিন্তু আমাকে অপমান করে কথা বলো।’
মেয়েটা হেসে বলল, ‘এসবকে গুরু মায়ের ভর্ৎসনা বলে নাও!’
বৃদ্ধ বলল, ‘তো আরাধনায় তো একটা কিছু আহুতি দেওয়ার দরকার হয়। তুমি কী আহুতি দিচ্ছ?’
‘আমাকে। আমি সমগ্র লোককে পাওয়ার সাধনা করছি। প্রকারান্তরে, সমগ্র লোকের সঙ্গে জড়ানো কাল আমার আরাধনার বিষয়। এবার দেখো, আমি, ব্যক্তি আমি একাই ব্যক্ত। এর অর্থ আমার, ব্যক্তি-আমার ব্যক্ত লোকের সঙ্গে জড়ানো কালটা, অর্থাৎ আমার ব্যক্তিগত কালটা হলো গিয়ে ওই সামগ্রিক কালের কাছে আহুতি। সামগ্রিক কালের ভেতর ব্যক্ত এই আমার কাল যখন লীন, তখন আমার উদ্দেশ্য সফল।’
‘আখেরে কী লাভ?’
‘তুমি লাভের আশায় আরাধনা কোরো না। লাভের ফল স্থায়ী নয় কিন্তু। আমার চাই স্থায়ী অর্জন। তোমাকে খানিক আগে বলা আমার সব কথাই কি ব্যর্থ হলো তাহলে?
লাভের আশায় আরাধনা করলে, ফলের আশায় কাজ করলে লাভ তুমি পাবে, ফল তুমি পাবে, ঠিকই। কিন্তু সেই ফল, সেই লাভ, ক্ষয়ও হয়ে যাবে। তোমাকে তো অক্ষয় অশেষের দিকে যেতে হবে। তুমি আরাধনা করবে প্রেমে প’ড়ে, যেন বিনিময়ে কিছু চাও না। প্রেম তো ওভাবেই করতে হয়। তুমি জানো না? তুমি কখনো প্রেমে পড়নি?’
বৃদ্ধ মুখ ঘুরিয়ে মনের ভেতরটা যেন গোছাতে লেগে গেল। ‘না, আমি সেই অর্থে বলিনি।’


‘তুমি আসলে কী জানতে চাইছ। দিনের শেষে আমার গন্তব্যটা কোথায়? উদ্দেশ্যটা কী এই পথচলা তো আর অর্থহীনতায় খামখেয়ালিতে ডুবতে পারে না। তুমি একটা কোনো উদ্দেশ্য চাইছ। উদ্দেশ্য চাইছ বলেই তুমি বারবার উদ্দেশ্য খোঁজ করছ। তাই না?’
‘হয়ত। হ্যাঁ। অনেকটাই।’
‘অস্তিত্ব আছে বলেই অস্তিত্বের সংকট আছে। সংকট আছে বলেই উত্তরণের শর্তে প্রেমের উৎপত্তি। আরাধনা করে কালেও ওই প্রেমটাই চাই।
প্রেমকে সমীকৃত করতে হিংসা আছে। প্রেম আর হিংসার দ্বান্দ্বিকতা আছে।
দুই পক্ষই সার্থক হয়। তুমি কোন পক্ষে থেকে সার্থক হতে চাও তা কেবল বেছে নাও।
ভারসাম্যের এই সব শর্ত আছে। শর্ত আছে বলে শর্তভঙ্গের তাড়নাও আছে। কী বুঝলে? সবশেষ অস্তিত্ব আছে বলে এই সব বোঝাপড়া আছে। আর কারো কারো এই বোঝাপড়ার মাথাব্যথা আছে বলে কারো কারো তা নেই।’
বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু তুমি এতোটুকুন মেয়ে, এতো বোঝার বোঝা কী করে নিচ্ছো?’
‘কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা না থাকায় এসব বোঝাপড়া আমার কাছে পালকের মতো হালকা। পাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকলে পাহাড়ের মতো ভারি।’
বৃদ্ধ বলল, ‘তোমার কি মনে হয় না এইসব ¯্রফে বড় বড় কথা। এসব দিয়ে কি মাঠে ফসল ফলে? এসব কেমন যেন, কৃত্রিম, মনে হয় না? মনে হয় না, এসব বোঝাপড়া, কথাবার্তা আমাদের এই ক্ষুধায় পাওয়া একটা কেমন নির্মম জীবনের সামনে রীতিমতো হাস্যকর? এসব কথা কেমন জীবনকে ছাড়িয়ে যাওয়া, সম্পর্কহীনরকম বড় বড়, মনে হয় না এমন?
মেয়েটা বলল, ‘আসলে দিনের শেষে কী হয় জানো? দিনের শেষে তোমার ওই ক্ষুধায় পাওয়া জীবনটা এসব কথার চেয়েও বড় বিস্ময়।’
হঠাৎ হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে মেয়েটা বলল, ‘দাঁড়াও, একমুহূর্ত! শুনতে পারছ? কী শব্দ আসছে ওই রাজারবাগ থেকে!
বৃদ্ধ বলল, ‘কী করলে তোমার কাজে আসব, বল। আমি ক্ষমা চাই যে শুরুতে তোমার সাথে আমোদ করেছি। সত্যিই আমরা অস্ত্র দিয়ে ফল ছিনিয়েছিলাম। ফলও যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এই সাধারণ কথাটা মনে ছিল না। তুমি কত সহজে ধরে দিলে।
মেয়ে, তোমার সাথে একটু ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা ভাগ করে নিই, দেখো? ক্ষণে ক্ষণে আমার আলো টেনে নিতে চাইছে ওই কালো মেঘ’; বৃদ্ধ কালো মেঘের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। আবার দেখো, ক্ষণে ক্ষণে তা আমাকে আবার ফিরিয়ে দিতে চাইছে ওই চাঁদ’;

মেয়েটা যেন খুশি হয়ে উঠল। তার চোখের পাতায় কিশোরীর চপলতা; বলল, ‘তুমি যদি আমার ওপর ক্ষমতা খাটাতে পারো, তো আমাকেও তোমার ওপর ক্ষমতা খাটাতে পারতে হবে। যদি তুমি আর কেবল তুমিই আমার ওপর ক্ষমতাবান হও, আমি তোমার ওপর না হই, তাহলে কিন্তু প্রকৃতির শর্তই ভেঙে যায়। তুমি কি আমার কথা ধরতে পারছ?’
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা চোখ বন্ধ করল পেছনে।
জানালার বাইরে রাতের সড়কবাতির আলো ফুটে থাকল দূরে দূরে। তার নিচে ফিতের মতো শুয়ে আছে ধূসর রাস্তা। আলোর অল্পই পর্দাহীন কাচ গলে ভেতরে এলো।
শহরের বসতি থেকে ছিটকে পড়া এ বাড়ি। বড় পুরনো এর ধাঁচ। কারা ছিল এখানে? কে জানে। এ বাড়ির ইতিহাস অন্ধকারে ঢাকা।
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, ‘অন্ধকার ইতিহাসের জন্য ভালো। অন্ধকার বৃষ্টির জন্য ভালো। অন্ধকার চাঁদের জন্যে ভালো।’
ঘরের এক কোণে কালো মেঘের ভেতর মৃদু শব্দে চিড়চিড়িয়ে বিজলি ডাকল আবার। বৃদ্ধের মাথার ওপর এবার আর এলো না।
ঘরের অপর কোণে ভেসে থেকে আলো ছড়াতে থাকল চাঁদ। আগের মতো ওঠানামায় নেই। বরং স্থির।
‘যতই বুড়ো হই, আমি আসলে মানুষ নতুনই।’ বলল বৃদ্ধ। ‘কারণ আমাকে এসব বলে দেওয়া হয় নাই। আমার জানতে এতো দেরি হলো, এতো কাঠখড় পোড়াতে হলো, এ বোঝাপড়ায় আসতে এতোটা সময় আমার পার হয়ে গেল। অথচ, অথচ আগামীকাল একটা শিশুও জানবে, ঈশ^র যদি মানুষের ওপর ক্ষমতাবান হয়, তো মানুষেরও ঈশ^রের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার কথা। এবং হয়েছেও তাই। না হলে সিস্টেম ধসে যেত।
আমি জানলাম, বুঝলাম, সবে আজ। এই কালো মেঘ, এই চাঁদ...’
এমনসময় ঘরের এক কোণে মেঘে বজ্রপাত হলো। বৃদ্ধ তাকাল সেদিকে। দেখতে পেল মেঘের ছোট্ট স্তূপটা চাঁদের সামনে এসে স্থির হয়ে আছে, যেন চাঁদটাকে আড়াল করে দিতে চায়।
ওদিকে মেঘের পেছনে থেকে ক্ষিপ্ত আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। এতো আলো এর আগে কোনো চাঁদকে কখনো বিকিরিত করতে সে দেখেনি।
ঘরটা একইসঙ্গে চাঁদের আলোয় আর বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে।
‘প্রকৃতি চক্রধর্মী! তার ধর্মকে মেনে নিয়েই তার সঙ্গে সম্পর্ক কর।’
হঠাৎ পেছনে কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল বৃদ্ধ। মেয়েটা চোখ খুলেছে।
‘তোমার ধ্যান ফুরোল?’
‘প্রকৃতি চক্রধর্মী, তাই পুনরাবৃত্তি সত্য। চাকা যখন সচল তখন স্থানাঙ্ক বদলায়, এবং এটাই প্রাকৃত, তাই নতুনত্ব এতো কাম্য মানুষের। নতুনত্ব এতো কামনার বস্তু সমস্ত প্রাণির। তারা পরস্পরের ওপর প্রভাব খাটায়। নতুনত্ব আমাদের প্রভাবক এবং আমরা প্রাণিরা, নতুনত্বের প্রভাবক।
আচ্ছা, বড়, বলো তো চাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস কাদের বেশি?’

বৃদ্ধ বলল, ‘আমি জানি না।’ ‘শিশুদের। কালের সংখ্যারেখা ধরে বিয়োগচিহ্নের দিকে হাঁটলেই শিশু হওয়া যায়। আমি তোমাকে সংখ্যারেখাটা এঁকে দিচ্ছি। তুমি শিশু হয়ে যাও। আবার শুরু করো। করবে?’
তরুণী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
বৃষ্টির তোড় বাড়ল ঘরের ভেতর। চাঁদের আলোর ঢেউ আরো বড় হলো।
বৃদ্ধ বলল, ‘বেশ। শিশু হলে তো একটা আমার নতুন জীবন পাই। শুধরে নেবো সব। সম্ভব তো?’
‘সম্ভব।’
বৃদ্ধ শান্ত মুখে মেয়েটার এঁকে দেওয়া সংখ্যারেখার ওপর পা রাখল।
জানালার জনশূন্য বাহিরটা বদলে যেতে থাকল এসময়। কেউ কি দৌড়ে গেল হঠাৎ? একটা যেন কালো ছায়া; নাকি চোখের ভুল।
নিজেকে ভীষণ নেশারু লাগছে বৃদ্ধের। তার পায়ের পাতা বদলে যাচ্ছে।
বদলে যাওয়া দেহে হঠাৎ মাথার ভারে আর পায়ের অনভ্যাসে টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই তরুণী তাকে জাপটে ধরে ফেলল।
‘ছাড়ো। আমি একাই খুব পারি।’
শিশুর কণ্ঠে আত্মাভিমান।
সশব্দে দরজা খুলে গেল এসময়।
সবার চোখের আড়াল হয়ে খোলা দরজা দিয়ে তখন বাইরে বেরিয়ে গেল চাঁদ আর মেঘ।
ঘরে প্রবেশ করল একদল মানুষ।
প্রত্যেকের পোশাক এক; পুরোপুরি সাদা, কেবল সেলাই পড়ার জায়গাগুলোয় কালো। পুলিশের পোশাক। ওদের কণ্ঠ উচ্চকিত, পেশি স্ফীত, অস্ত্র উদ্যত।
‘তুমি একা কেন। বাকিরা কোথায়?’
‘আমি একাই ছিলাম।’
‘ মোটেই না। সবক’টাকে আমাদের চাই। সব শুনেছি আমরা।’
‘আড়ি পেতেছিলে?’
‘যা পেতেছি তাকে আড়ি বলে না, বলে ফাঁদ। বল কোথায় লুকিয়েছে। নয়তো এদের লেলিয়ে দেবো।’
মেয়েটা দেখতে পেল পেছন পেছন আরো কিছু তরুণ-তরুণী ঘরে এসে ঢুকেছে। এদের পোশাক পুলিশের উল্টো। প্রত্যেকের দেহে কালো পোশাক কিন্তু সেলাইয়ের অংশটুকু সাদা। ওদের কাপড়ে ঢাকা মুখ দেখার উপায় নেই।
ওদের দেখিয়ে পুলিশের পোশাকধারীদের একজন বলল, ‘ওরা যা করবে- তা কিন্তু আমাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর! ভালোয় ভালোয় বলে ফেলো। বুড়োটা কোথায়, বাচ্চাটাই বা কোথায়!’
‘ওরা সবাই আমার ভেতরে।’
‘তুই যে ডাইনি তা কি আজকের কথা?’ হিসহিসিয়ে বলল আরেকজন।
‘তোমাদের শরীরেও ওরা আছে। প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসবে ওরা। বের করে আনো।’
হড়বড় করে বলল মেয়েটা।
‘প্রশ্ন করে বের আনবো!’ বিস্মিত পুলিশের একজন।
‘আবার বল তো! আরেকবার বল কী বললি! প্রশ্ন করে বের করে আনব?’
কণ্ঠগুলো সমস্বরে ঘর ফাটিয়ে হাসতে থাকল।
হঠাৎ প্রথমবার কথা বলে ওঠা পুলিশ লোকটা তাকাল অপর ওই দলের দিকে। চোখে স্পষ্ট ইশারা। যেন বলল, যাও, পথ পরিষ্কার তোমাদের!

অপর দল থেকে একজন হাত তুলল। ‘আর আপনারা?’
‘আমরা?’ বলল পুলিশ সদস্যটি। ‘আমরা তো মৃত্যু নিশ্চিত করব! তোমরা আগাও। ভয় নাই। আনন্দের সাথে আগাও!’
উপর্যুপরি আঘাতের প্রত্যেকটা তরুণীর খুলি কেটে বসে গেল, বুকের গভীরে পৌঁছাল। খুলিতে বসানো অস্ত্র ফিরে এলো, বুকেরটা আর ফিরল না। আটকে গেছে পর্শুকার খাঁচায়।
কেউ একজন শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘থাক।’
পুলিশদের ভেতর থেকে একজন এসে বাঁ হাতের কব্জির ওপর তার ডান হাত রাখল, তারপর পিস্তলের ঘোড়া চাপল তিনবার।
পরমুহূর্তে বাহিরটা একবার বজ্রের ভয়ানক ঝিলিকে ঝিকিয়ে উঠল, আর সেই ঝিলিকটা টুকে নিয়ে তার আয়নায় আটকে ফেলল চাঁদ।
ঠিক তখন দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজার কবাট বন্ধ হয়ে গেল। বাহির থেকে ছিটকিনি তুলে দিলো কেউ। কারা যেন ঢিল ছুড়ল জানালায়। চুরচুর করে ভেঙে পড়ল কাচ।
বাড়ির চারপাশটা যেন বহু লোকে ঘিরে ফেলেছে। ওরা কথা বলছে নিজেদের ভেতর। বন্ধ দরজার নিচ আর ভাঙা জানালা দিয়ে সেই মিলিত স্বর একটা দানবীয় মন্ত্রপাঠের মতো ঘরে আসছে।
ঘরের ভেতর, প্রত্যেকে, পরস্পরের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। মুহূর্তে কেমন বিভ্রান্ত আর ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে সবাই।


Robert Gibbons

Robert Gibbons received his MFA in Creative Writing in 2018 from City College in New York. He is the recipient of many awards and publishing credits. His first collection, Close to the Tree, was published in 2012 by Three Rooms Press.
Oh, the ocean


I heard the story. The man named John wanted to proselytize on a restricted island located off the coast of the Indian Ocean. And the people were called the Sentinelese a 55,000 year old civilization that refuse to conform. They were not willing to modernize.

Not willing to gentrify into a world that is as fast and as long as it will last.

The people, the Sentinelese, considered tribal or primitive or any of those textbook phrases are not inhibited, are not limited to our idea of society and what is wrong with keeping your person close, they will not be coerced, to innovate, not the will of the peopleto invite a resort , a casino, a development, a cohort of island with miniature golf cars to live beneath the radar, without car or airplane, without chaos or the insane, not the paved roads of our conquerors, not the blasphemous loads of steel or machinery, the Sentinelese, their animistic bodies are marvels for the curious, for the purity of Christendom, an art object for the museum cabinet, maybe a display for the zoo a crew of elephants domesticated appropriate without social, or economic, or political, non- status seekers, cultural phonics and his name was John, he rented a boat to traverse the mighty waters, the restricted area of our histories, the Nicobar, the Andaman, the Indian, all the names we call, and tried to pay them, tried to pray for them, tried to anoint them into the New World, in the Old world would travel by canoe with Bible in hand, a man of land of country, of privilege, of means in between this heaven we call hell, this Dante’s purgatory, his Christian-missionary self came to tell them about Jesus, about the crucifix, as if Columbus is not in our thought bought and sold small pox, as if the Santa Maria, Nina, and the Pinta, did not arrive the Amerigo Vespucci in him, with all the self- regard for his nation, John-the-Conqueror John-on-the-Cross met them, the Sentinelese, a people, a warrior, a sect, a tribe, an animist, a blame, for the loot, for the booty, for the conspiracy, for the piracy, to tell them about God far from their island, a God that is a star, in this myriad planet, in this pantheon of poly-god, and polytheism, a mob of them with bow and arrow, call him Roque, or her


Crow- mother, call them devastation or destruction, John-the Conqueror, his Bible Shot him back to the ocean, back to the baptism of Pochantas, shot him back to the Crucified, like Calvary, a blood bath as communion, a blood bath as indigenous, a dragging a hanging, an insurrection beyond border, beyond state of the union, a mutiny like Amistad his body a breach, a reach beyond latitude, beyond ship wreck, the tetonic plates will implode and the land will return Pangea. Will Gawanda, will glaciate, will ice over in the kingdom come will rain murder, and trial and tribulation, will be 40 days of Noah on the rainy tide, when the ocean becomes land and the land become ocean, Oh ocean, drown me Oh ocean, flood your gates, make me mud lotus, great fertilizer, great murderer, my body will be like his a decomposition, great murderer, unction me to the great
Beyond, transpose me into plankton, into amoeba, into keel, and then John saw and number that no man could number, his body the great revelator, Oh, the Ocean is mother ocean her porous landscape, the ways she mates life and death.
The way breath suffocates, and the consulate wants his body back, but he is taken he is flight and elegy, when our body is baptized in Jesus’s name, Oh ocean, submerged in your liquid grave, the waves are contentious, the moon and tide roar back to God, Oh, ocean is the photosynthesis to mention when my body becomes ecosystem or am I a philistine as caverns of the body becomes sunshine, part pine needle, stymied energy, pent up in me, oh, ocean, the part of me to be pure, water, pure whisper, and sound, Rumi’s water wheel, my trajectory protected landscape. I can be so shallow as I follow hegemony. Ocean, feel the motion as I caracole your water, may I farrago, may I embargo in you. Oh, sacred space, O, Ocean, O, Soul, mold me of the amphibious and indigenous humbled by you. O, Ocean, O, Soul, still in search of the old gold, will take back my nativism in your caverns of blue and infinite where we live only as tenement on earth, O, Ocean, only death, only death.


Kay Salady

Kay Salady is an Author residing in Seattle, Washington who believes that everyone has a gift and those gifts should be shared with one another. Her motto, "love is everything" means everything to her. She writes from the heart, if not with her soul and attempts to instill elegance within the written word. Her favorite medium is poetry.

The Shadows Follow

The shadows followed the little girl, more quickly than the sun, deep into an emerald canopy. And as she ran, the whispers came, through leaves on branches of mighty trees that stood high above the forest floor. Branches whose arms cradled life which held its breath in silence, as a menacing murmur chanted from behind two small feet, scurrying over the decay of all that fell to replenish the soil, which fed the green grove surrounding her steps. A berry-stained basket of woven wood held firmly in her tiny hand, tapped against her knee in rhythm as her pace quickened, as well as her breath. Beads of perspiration gathered at her forehead as strands of tawny hair clung before her eyes. She was running in circles in a state of confusion, and all the trees began to appear quite the same. The buzz of a fly or the snap of a twig enticed her anxiety. Her heart was pounding in her chest and ears. The entire world had left her alone in this place . . . she was abandoned in this beautiful, dark and ominous place.



মনদীপ ঘরাই
সাক্ষাৎকার
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
গল্পের শিল্প সত্যিকার অর্থে আপেক্ষিক। যে আলোতে দেখবেন, গল্প সে রকম আভা ছড়াবে। তবু, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গল্পের শিল্প তার জীবনবোধের সঠিক বুননেই নিহিত।
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
অবশ্যই জীবনকে এবং জীবনকে প্রাধান্য দেই। কারণ, কল্পকাহিনী বলে কিছু নেই। সবই জীবনের এপিঠ, না হয় ওপিঠ।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
এই গল্পের নিরীক্ষাটা মনের পরিবর্তন নিয়ে। সেই সাথে পরিচিত-অপরিচিতের মিশেল নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়েছে। জানি না কতটুকু পেরেছি।
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
গল্পের ফর্ম, স্টাইল আজকাল আমরা গুলিয়ে খেয়ে নিয়েছি। যার যার নিজের মতো। এ নিয়ে চুপ থাকতে চাই।
বাংলা গল্পে এ নিয়ে কি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে? হলে কিভাবে হয়েছে। বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
পরশুরাম, বনফুল থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ। গল্প নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গল্পের শুরু নিয়ে খেলেছেন সবাই সবচেয়ে বেশি। হুট করে শুরু হওয়া থেকে গোছানো শুরু। কি নেই এই বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে? এখনকার যুগটা তাড়াহুড়োর। প্রযুক্তির। তাই গল্পকারদের মধ্যেও সে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। বিকাশ থামে নি। থামার নয়। বদলেছে রং ও রূপ।


বৃষ্টিপাগল পাখি

রাত-দুপুরে ভ্রমণটা ইচ্ছে করে না রানার। চাকরিটাই এমন। রাত তিনটায় স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা ছাপা হলেই ছুটতে হয় রাজধানীতে। মালিকের বাসায়। সকালের চায়ের আগে পত্রিকার তাজা কপিটি পত্রিকার মালিকের চায়ের ট্রেতে তুলে দেয়াই তার কাজ। ওটা ছাড়া নাকি তার দিনই ঠিকভাবে শুরু হয় না।
বেতন খারাপ না। মা-বাবা আর এক বোন নিয়ে ঠিকই চলে যায়। ঝামেলা একটাই। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা। আবার ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল। একেবারে রোজ।
সারাবছর অপেক্ষায় থাকে কবে নববর্ষ, মে দিবস আর বিশেষ দিনগুলো আসবে।
ঝামেলা যেমন একটা বললাম, আক্ষেপও একটা। মালিকের সাথে আজ অবধি দেখা হয় নি। মালিক জিবরান সাহেব জানলেনও না, এই ছেলেটা রোজ কত কষ্ট করে পত্রিকাটা পৌঁছায় তার জন্য।
একদিন দেখা করতে চেয়েছিল, কিন্তু বদখত দারোয়ানটা খ্যাচ করে উঠলো,
" অই, তোর আবার দেখা কি রে! এঃ কষ্ট কইরা নাকি আসে! ক্যা রে তোরে হ্যায় বেতন দিয়া পুষে না? মাগনা করস কাম?"
আর কথা বাড়ায় নি রানা। মুর্খ লোকের সাথে তর্ক করা বৃথা। অবশ্য সে ডিগ্রী পাশ করেই বা কি হাতিঘোড়া করছে! এমন চাকরি করে মানুষকে বলতেও পারে না।
আচ্ছা তার পদের নাম টা কি?
একে একে কয়েকটা অপশন মাথায় আসলো:
নিউজপেপার এক্সিকিউটিভ, পেপার অফিসার, নাকি ডাকপিয়ন?
শেষটা মনে আসতেই মনটা দপ করে নিভে গেল। সে আসলে তো ডাকপিয়নই!
নভেম্বর মাস। বৃষ্টি হবার কথা তো না! প্রথমে টিপটিপ আর এখন টিপটিপের বাবা অর্থাৎ ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। পলিথিনে পত্রিকাটা মুড়ে নিয়ে স্ট্যান্ডে আসলো রানা। নিজের ভেজা ঠেকাতে পারেও নি। চায় ও নি।
বাসের পেছনের লাল আলোটাকে বৃষ্টিমাখা দেখতে মন্দ লাগছে না। কেমন জানি সিঁদুরে একটা আভা। মেঘের সিঁথিতে মেখে দিলে মন্দ হতো না।
ধুর! কি ভাবছে এসব। এই কবি কবি ভাব পিয়নের মানায় না। কাউন্টারে গিয়ে টিকেট নিলো ঠিকই, বাসে উঠতে উঠতে ওটাও ভিজে চুপচুপে। পাসের সিটে হাতলে কাপড় শুকানোর মতো করে টিকেটটা শুকাতে দিলো। এরপর সিগারেট ধরাতে গিয়ে থামলো। বাসে ধরানো ঠিক হবে না।
এই তো বছর কয়েক আগেও বাসের টিকেট কাটার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতো, ইস! পাশে যদি কোনো সুন্দরী মেয়ে বসতো...
আর এখন? খুব করে প্রার্থনা করে যাতে পাশে কেউ না বসে। আরামে একটু ঘুমিয়ে যাওয়া যাবে। সাথে আয়েশ করে পত্রিকাটাও পড়া যাবে মোবাইলের টর্চের আলোতে।
কখনকার চাওয়া যে কখন অনুমোদন হয় কে জানে? হয়ত বছর দশেক আগের করা কোন প্রার্থনা আজ অনুমোদিত হয়েছে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন এক মেয়ে এসে বললো,
" এক্সকিউজ মি, জানালার পাশের সিটটা আমার।"
এর মধ্যেই কেউ আসবে না ভেবে আয়েশ করে আধো আধো শুয়ে গেছিলো রানা। ধরফরিয়ে উঠে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বললো, " প্লিজ"


মেয়েটা কিছু শুনলো কিনা বুঝতে পারলো না রানা। কানে ইয়ারফোন। চুপ করে যেয়ে সিটে বসলো।
দশ বছর আগে হলে ঠিকই মেয়েটার ব্যাপারে কৌতুহল দেখাতে ছাড়তো না। সময়ের ঢেউয়ে ওসব ভেসে গেছে কবে...
মোবাইলের আলোতে গরম গরম ছাপা পত্রিকাটা পড়তে শুরু করে রানা। প্রতিদিনই এক কপি বেশি করে আনে। ব্যাকআপ। পত্রিকা পড়তে পড়তে সময়ও কেটে যায় বেশ।
-এটা কি আপনার?
দুই সিটের মাঝখান রাখা হাতলের দিকে ইশারা করে রানার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল মেয়েটা।
-আরে না না। ওটা আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। প্লিজ।
-মানে ? এই টিকেটটা কি আপনার না? আমি ইউজ করব ? যড়ি ভঁহহু!
মুহূর্তেই লজ্জ্বা পেয়ে যায় রানা। একটু আগে হাতলে ভেজা টিকেটটা সেই তো শুকাতে দিয়েছিল।বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি টিকেটটা পকেটে ভরলো সে।
ততক্ষণে দুর্ঘটনা একটা হয়ে গেছে। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে রানার। কিসের দশ বছরের ইতিহাস! রানা হারিয়ে গেছে তার সহযাত্রীর স্নিগ্ধতায়। সুন্দরী শব্দটার চেয়ে স্নিগ্ধ শব্দটাই বেশি বেশি মনে আসলো তার।
শুরু হলো সবকিছু লক্ষ্য করার অপরিচিত খেলা।
লাল ড্রেস, হাতে চুড়ি, হাতব্যাগের সাথে ঝোলানো অ্যাপ্রন... এমনকি কানের ইয়ারফোন... ওটাতে লেখা ংশঁষষ পধহফু.
এখানেই থামে রানা। এ কেমন নাম স্কাল ক্যান্ডি? মেয়েটা ডাক্তার বলেই কি স্কাল-টালের দিকে আগ্রহ বেশি নাকি? আচ্ছা, এই ঝুম বৃষ্টিতে সে না ভিজে গাড়িতে উঠলো কিভাবে? প্রশ্নটা তাড়া করে ফেরে। উত্তর জানার উপায় নেই। কার দুঃসাহস আছে সাপের লেজে পা দেয়ার।
দ্বিতীয় দফা বৃষ্টির সাথে দেখা। হঠাৎ বৃষ্টির শব্দ আর নীরবতা ভেঙ্গে মেয়েটা বলে উঠলো,
"এক্সকিউজ মি, জালনাটা একটু টেনে দেবেন?"
রানার জানালা টানার স্পিড দেখে মনে হলো তার পেশাই বাসের জানালা টানা।
-থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমার কথায় কষ্ট পাবেন না। আসলে ওভাবে বলতে চাইনি কথাটা।
-আরে ধুর। কি বলেন। এটা কোনো ব্যাপারই না।

রানা ভেবেছিল গল্প জমবে। কিন্তু না। ততক্ষণে মেয়েটার কানে ঢুকে গেছে স্কাল ক্যান্ডি।
রানার মনের সাগরে যেন জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। সিগনালের ব্যবস্থা থাকলে নির্ঘাত ১০ হতো। কিংবা তার চাইতেও বেশি কিছু....
এসব সফরের একটা সুখকর দিক আছে। ফুল অব সারপ্রাইজেস। হঠাৎ গাড়ী বিকল। ওদিকে সূর্য আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বৃষ্টি বেড়েছে।
একটু একটু করে গাড়ীর সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা দেখা দিচ্ছে। রানারটা আরও একটু বেশি। চায়ের ট্রেতে পত্রিকা না পৌঁছালে আজ থেকে হয়তো চাকরিটাই থাকবে না। সে অটো নিয়ে চলে যেতে পারতো। বাধ সাধলো স্কাল ক্যান্ডি। না যাই হয়ে যাক, বাস থেকে সে নামবে না। আড়চোখে লক্ষ্য করলো, জানালাটা একটু ফাঁকা করে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে মেয়েটা।
দুম করে বৃষ্টির মধ্যেই থেমে থাকা বাসটা থেকে নামলো রানা। ফিরলো মিনিট পনেরো পর। চোখেমুখে বিজয়ীর ঝলক। ভিজে নেয়ে এসেছে সে। রুমাল দিয়ে মাথা মুছে পাশ ঘুরেই বললো,
-এই নিন। ইয়ারফোনটা খুলে রানার হাতে একটা আধা পানি ভর্তি বোতল দেখে বললো,
-এটা কি?
-না মানে আপনি বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছিলেন তো, তাই বৃষ্টিকে বোতলে বন্দী করে আনলাম। আপনার জন্য।
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সে বোতলটা নিল ঠিকই, তবে সিটের সামনে রাখা পকেটে রেখে দিল। একচিলতে হাসিও কি দেখেছিল রানা? ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না।
সে যাই হোক, আর দেরি করে না রানা। পত্রিকার অতিরিক্ত কপিটার ওপরই লিখতে শুরু করে দেয়। কবিতা। কিংবা মন মেলে লেখা শব্দগুচ্ছ।
লাল পোশাক, বৃষ্টি আর একরাশ অজানা আবেগ নিয়ে গড়ে তোলে ছন্দের ভাস্কর্য।
গাড়ী পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। রানা টেরই পায় নি।কখন যে গাড়ি ঠিক হলো আর কিভাবে যে পৌঁছালো কে জানে! লেখায় ডুবে ছিলো পুরোটাই। পত্রিকার ছাপার অক্ষর আর তার হাতের লেখার মিশেলে কবিতাটা খানিকটা সিক্রেট কোড টাইপের মনে হয়।
চোখের সামনে নেমে গেল মেয়েটি। হা করে অনেক ক্ষন সেদিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ নজর আটকালো তার সিটের সামনের পকেটটাতে। মেয়েটা মনে করে ঠিকই নিয়ে গেছে বৃষ্টিবন্দী বোতলটা। আহা। কি ভুলটাই সে করেছে! নামটাও শুনলো না? ঠিকানা কিংবা নাম্বারও রাখলো না! ভয়ানক মন খারাপ আর একটা চাপা ব্যথা বুকে নিয়ে ছুটে চললো জিবরান সাহেবের বাসার দিকে। বেঁচে গেছে রানা। ঠিক সময়মতো পত্রিকা পৌঁছাতে পেরেছে। তবে বৃষ্টিতে কপিটা ভিজেছে খানিকটা। ফিরতি বাসে উঠেই কবিতাটা পড়তে মন চায়। পত্রিকাটা খুলে রক্ত হিম হয়ে আসে। পত্রিকাতে কিছুই লেখা নেই। চাকরিটা আজ নির্ঘাত যাবে। ভুল করে কবিতা লেখা ব্যাকআপ কপিটা দিয়ে এসেছে মালিকের বাসায়। শুরুর চিন্তাটাই আসলো; চাকরি খুঁজতে হবে। তারপর মনে হলো, পরিবার চালাবে কিভাবে? সারাটাদিন মেঘলা আকাশের মতো মনটাও মেদুর হয়ে থাকে রানার। অন্তরে তোলপাড় হলেও কারও কাছে কিছু বলে না সে। রাতে অফিসে ঢুকে অবাক। ঢাকা থেকে মালিক ফোন করেছিল। কাল সকালে রানাকে জরুরি দেখা করতে বলেছে। রানার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই।

রাত আড়াইটা। পত্রিকার দুটো কপি নিয়ে ফের বাসে ওঠে রানা। শেষবারের মতো দায়িত্বটা পালন করে আসতে যাচ্ছে হয়তো। আজ অনেক চেয়েছে পাশে এসে বসুক কালকের সেই লাল বসনা ডাক্তার। চাইলেই কি আর সব মেলে? আজ পাশের সিটটা খালি। স্বভাবতই আধশোয়া হয়ে শেষবারের মতো পত্রিকাটা খোলে সে। মোবাইলের টর্চের আলোয়। একটা কলামে চোখ পড়তেই ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। ভুল দেখছে রানা? এ কিভাবে সম্ভব? পত্রিকাটির দ্বিতীয় পাতার নিচের দিকে ছাপা হয়েছে তার কবিতাটি। বেশ বড় ফন্ট এ। তবে লেখকের নাম দেয়া নেই। আছে পদবি। যার সংকটে সে ভুগেছে কাল অবধি। মালিকের হাতে পত্রিকা পড়ার পর কবিতাটি দেখে নিজেই ইমেইল করে পত্রিকা অফিসে পাঠায় ছাপানোর জন্য। সেই সাথে রানাকে একটা সম্মানজনক চাকরি দেয়ার জন্য তলব করে বাসায়। চাকরি থেকে বের করার জন্য নয়।
নিজের লেখা কবিতাটিই অবাক বিস্ময়ে আবার পড়তে থাকে রানা। এ যেন সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা কবির কোনো লেখা.....

বৃষ্টিপাগল পাখি
কবি: সুসংবাদ বাহক

দিলে তো সব এলোমেলো করে
পাখি আবার লাল হয়েছে কবে?
বসনে না হয় হয়নি; হয়েছিল লাজে।
এই পাখিটা বসনেতেও রাঙ্গা
ঠিকানা তার মনের জল আর ডাঙ্গা
আমি ধরতে চাওয়ার হাজার বছর আগে।
মুখ লুকিয়ে উড়াল দিলো রাগে-অনুরাগে।
ওহে বৃষ্টিপাগল পাখি....
বৃষ্টিকণার মতো করে আগলে ধরে রাখি?

পত্রিকাটা সেদিনের মতো আজও ভিজেছে। সেদিন ভিজেছিল বৃষ্টিতে। আজ ভিজছে আনন্দ আর বেদনা মেশানো চোখের জলে...
পিন্টু রহমান
ইন্টারভিউ
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
কাল বা সময়কে উত্তীর্ণ করার মধ্যে গল্পের শিল্পমান নিহিত। প্রকার-প্রকরণ কিংবা আঙ্গিক নয়, বিষয়বস্তুর নিরিখে যেসব গল্প কালোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলোই শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
বস্তুত সময়কে ধারণ করেই শিল্প-সাহিত্য। তবে ব্যক্তিভেদে ধারণের কৌশলে ভিন্নতা রয়েছে। সমকালীন সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় কুসংস্কার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচারণসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ আমার গল্পের অনুসঙ্গ। মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান আমি। কৈশরের দিনগুলোতে যেসব গল্প বাবা-মার মুখে শ্রবণ করেছি পরবর্তীতে ওইসব কাহিনী আমার লেখকসত্ত্বায় রেখাপাত করেছে- হয়তো এ-কারণেই উল্লেখিত বিষয় আমার লেখা গল্পে আলোচ্য হিসেবে এসেছে।

এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
গল্পে নিরীক্ষা করার সুযোগ খুব বেশি একটা আছে বলে মনে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরীক্ষার নামে আমরা যা করি তা আসলে পরিবেশনের কৌশল; গল্প বলার কৌশল। সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসভিত্তিক গল্প রচনার ব্যাপারে নিজের মধ্যে বিশেষ তাড়না বোধ করছি। ইতিহাসের পাত্র-পাত্রী, স্থান-কাল অক্ষুন্ন রেখে সংলাপের মাধ্যমে পাঠককে বিশেষ আবহের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা! ‘দহনকাল’ শিরোনামের গল্পটি তদ্রুপ- পলাশীর প্রান্তরের ঐতিহাসিক পেক্ষাপট তুলে ধরেছি।
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বাংলা গল্পের ইতিহাস গৌরবজনক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে জন্ম নেওয়া সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটি সমৃদ্ধির পথে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। গল্পের বিকাশধারা বাধাগ্র¯থ হওয়ার মতো ঘটনা অন্তত আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে হা, গত ১৫/২০ বছর শুধু গল্প নয় সাহিত্যের অন্য মাধ্যমও বিষয় হিসেবে সমকালীন রাজনীতি, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয় ও শাসকশ্রেণীর কর্মকান্ড কৌশলে এড়িয়ে চলছি- যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। যত দ্রুত সম্ভব এ অবস্থার উত্তরণ করতে হবে। তা না হলে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক বিকাশধারা ব্যাহত হবে।

দহনকাল

কাজলা ও কাজলীর প্রেমিক আমি! দুজনকেই ভালোবাসি। নাহ, মেয়েতে মেয়েতে বিদ্বেষ নেই, ক্ষোভ-আক্ষেপ নেই, গ্লানি যা তা শুধু আমার! বন্ধুরা বলে, চমৎকার কাহিনী! এ নিয়ে জমজমাট সিনেমা হতে পারে। হয়ই তো! আমার গল্পে গান আছে, পাত্র-পাত্রী আছে, অসংখ্য খলনায়ক, যাতনা আছে; আছে যৌনতাও! যৌনতা শিল্পের পর্যায়ে থাকলে আপত্তি ছিল না। মীর জাফররা যা করেছিল তা বলাৎকার! অসম দেহ, মন ও বয়সের বলাৎকার। যৌবণ যতোই টসটসে হোক শরীরে কতই-বা সহ্য হয়; কাজলাও সইতে পারেনি, গলাকাটা মুরগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করেছে। রাতের নির্জনতায় দাঁতে ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। পশুদের পাশবিকতায় শরীরে লালরক্তের স্্েরাত। রক্তের ওই স্্েরাত কী সহজে থামতে চায়! শরীর নিংড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের শেষ বিন্দু যেখানে ঝরেছিল সেখানকার মাটি আজো অনুর্বর। নোনতা। কাজলার মুখের পানে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, মেয়েটি রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। চোখের নিচে কালি। চওড়া কপালে কলঙ্কের তীলক লটকে আছে। লাল রক্তের মতো টিপ দেখে পুনরায় ভুল করেছিলাম আমি।
দুর্ভাগ্য!
আর কতো মাশুল গুনবো!
নক্ষত্রের পানে চেয়ে চেয়ে ক্লান্তপ্রায়। কারণে অকারণে দীর্ঘশ্বাস ঝরে। কে আমার- কাজলা নাকি কাজলী? নাহ, কিনারা করতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, রিক্ত, শূন্য আমি। কতিপয় ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। বিরহের সজ্জায় এপাশ-ওপাশ করি। অভিমান ভুলে কাজলীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করি। মানুষের ভুল হয়, ভুল করে; আমিও ভুল করেছি।

আহা, মেয়েটি আমায় গল্প শুনিয়েছে! চাঁদের আলোয় পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমের ছায়া মাড়িয়েছে! চোখের সম্মুখে বিস্তীর্ণ আ¤্রকানন। কুয়াশার চাদঁর মাড়িয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালে ক্ষণকালের জন্য চুপ হয়ে যেত। দূরের গ্রামগুলোর পানে চেয়ে থাকতো। কাজলার জন্য মায়া হতো তখন। কাজলীও সম্ভবত কাজলাকে অপছন্দ করতো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বুঝলে মশাই, নদী দিয়ে কতো স্্েরাত যে বয়ে গেছে!
¯্র্েরাত আমি দেখিনি তবু বলি, হুম, জানি তো। ধূর পাগল তুমি কিভাবে জানবে?
কাজলীর মুখে পাগল ডাক শুনতে খুব ভালো লাগে। নিজের বিশ্বাসের ওপর জোর রেখে পুনরায় বলি, আরে বাবা, বললাম তো জানি আমি।
কাজলী বিশ্বাস করে না, হেঁয়ালি করছো কাজল?
আমি মাথা নাড়ি, না।
মেয়েটির চোখেমুখে তখন কৌতুহলের ছায়া- আর কি কি জানো তুমি?
পড়া না-পারা বালকের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি। কাজলী ইতিহাসের পাঠ শেখায়, আহা, নদীর স্্েরাতে অসংখ্য লাশ ভেসে গেছে। কতো মানুষ নিঃস্ব হয়ে নদীপাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে ঘর বেঁধেছে। ওই যে, সামনে যে গ্রামটি দেখছো, ওটা ছিল ভয়ঙ্কর জঙ্গল। ঘরহারা এক মাঝি প্রথম কুঁড়ে তুলেছিল।
তারপর!
প্রথম কুঁড়েটা লক্ষ্য করে দু’একজন করে আসতে লাগলো, বেড়ে চললো সীমানা; এখন তো মস্ত বড় একটা গ্রাম! অথচ আফসোস কী জানো, ওই মাঝির কথা আজ আর কারো মনে নেই!
মাঝির কথা ভেবে মনের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হয়। মনে মনে ভাবি, ঘরহীন মাঝি-মল্লারাই জনপদের নির্মাতা! কাজলী একাত্তরের কথা শোনায়। আমি যেতে চাই আরো পিছনে। ভগীরথির তীরে পলাশীর প্রান্তরে। কাজলার বুকে কান পাতলে ঘোড়ার পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুরের আঘাতে ধূলো উড়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঘোড়াগুলো কার; যাচ্ছেই বা কোথায়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও তার বাহিনী, মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা অভিমুখে ছুঁটে চলেছে। ইস, অল্পের জন্য মীর জাফর আলী রক্ষা পেয়েছে। কুঠুরির খবর জানলে আস্ত রাখতো না।
আহা, নবাব যদি ওই কুঠুুরির খবর জানতেন!

কাজলার প্রতি সাময়িক অভিমান হয়। সে নিজেও গোপন কুঠুুরীর প্রত্যক্ষদর্শী। ফিসফিস করে খবরটা যদি নবাবের কানে পৌঁছাতো, বাংলার স্বাধীনতা বিপণœ হতো না। যেদিন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না সেদিন উচ্চস্বরে গালমন্দ করি- বেইমান! মীরজাফর! স্বদেশের সাথে বেঈমানী করতে তোর বুক কাঁপলো না! আর কতো অভিশাপ কুড়াবি। অভিশাপের আগুন তোকে ক্ষমা করবে না। তোর জন্যই কাজলা আজ অভিশপ্ত। আরে বেইমান, বীর মরে একবার আর তোকে মরতে হবে লক্ষ-কোটিবার! ভেবেছিলি মরে বাঁচবি, তাইনা? মরেও শান্তি নেই। থুতু ছিটাই তোর নামে।
দ্রোহের আগুন লর্ড ক্লাইভকেও স্পর্শ করে। নীলকুঠির স্থাপনায় লাত্থি মারি, শুয়োরের বাচ্চা ইংরেজ বেনিয়া! এ মাটির সন্তান বদলা নিয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে হলেও দেশ থেকে উৎখাত করেছে। আরে বাপু, এতই যদি বাহাদুর তো লেজ গুটিয়ে পালালি ক্যান!
আমি রাগলে কাজলী নিরব হয়ে যায়। অবাক হয়ে চোখের পানে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে হোঁচট খায় বোধহয়। চেনা মানুষটাকে খুব বেশি অচেনা লাগে। মন-মেজাজ তিরিক্ষি না থাকলে নতুন গল্প শোনায়। অভিশপ্ত কাজলার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বর্ণনা করে- মেহেরপুর জনপদের পরিচিতি মুখ সে; কাজলা নদী। ¯্রােত হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। দু’পাশে বিস্তির্ণ চর। একদা যেখানে মাছেদের অভয়ারণ্য ছিল সেখানেই আজ চাষীদের ঘরবসতি। ঘরের পাশ ঘেঁষে ফসল; পূবালী বাতাসে ফসলের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায়। পাটের বাড়ন্ত ডগাগুলো যেনো নেচে নেচে কুর্ণিশ করে! মাঝিয়ালদের বিবমিষা। কাজলার রূপ-লাবণ্য কেবলি ইতিহাস। মাথাভাঙ্গার শাখানদী সে। কাজিপুর ইউনিয়নে মাথাভাঙ্গা থেকে বেরিয়ে নপাড়া, ভাটপাড়া, সাহারবাটি, গাড়াডোব হয়ে আমঝুঁপিতে বাঁকবদল করে ভৈরবে পতিত হয়েছে। কথিত আছে, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্যে মোঘল সেনাপতি মানসিংহ ১৫৮৯ সালে নদীপথে মেহেরপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন। শুধু সেনাপতি নয় স্বয়ং নবাবের পায়ের ধূলো পেয়ে জনপদ ধন্য। ১৭৫০ সালে নবাব আলিবর্দী খাঁ নদীপথে মেহেরপুরে আসেন। দুর্যোগ কবলিত হয়ে রাজু গোয়ালিনী নামের নামগোত্রহীন এক বিধবার আতিথ্য গ্রহণ করেন। নদীটি অসংখ্য ঘটনার সাক্ষি; পাথরচোখে অনেক ভাঙাগড়া অবলোকন করেছে!
াজলীর চোখে জল; ইতিহাসের পাতায় পাতায় জলের ধারা। কাজলার সংস্পর্শে ইদানিং নেশাগ্রস্ত। নেশার ঘোরে পথ হারাই। জলে নামি। দূর থেকে ভেসে আসে মুর্শিদি, মারফতি, ভাওয়াইয়া, রাখালিয়া গানের সুর! উদাস করা সুরে প্রাণ আকূল হয়ে ওঠে। এ সুরের উৎস কোথায়! ঘাটের সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে চারপাশে লক্ষ্য করি। কখনো মনে হয়, এইতো কাছেই; বাগানের মধ্যে কেউ একজন বাঁশিতে সুর তুলেছে। সুরের মূর্ছনায় আসমান-জমিন একাকার! হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত, শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। তথাপি শিল্পী ও সুরের উৎসে বিভ্রান্ত হই। মাঝে মাঝে এও মনে হয়, বোধহয় জ্বীন-পরীদের খপ্পরে পড়েছি।
আমঝুপির জীবনে আমূল বদলে গেছি। অন্য কারো সান্নিধ্য ভালো লাগে না। পায়ে পায়ে কাজলার তীরে হাজির হই। আনমনে কথা বলি। কুঠির আশেপাশে পায়চারি করি। ঘাটের সিঁড়িতে বসে হা-পিত্যেশ করি। সিঁড়িটাও অভিশপ্ত। নীলকরদের বহনকারী নৌযান ঘাটে নোঙর ফেলতো। তারপর অট্টহাসির কলোরোল মুখে নিয়ে অন্দরমহলে! ভগ্নপ্রায় দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই হাসি কানে বাজে। উফ, কী বিভিষীকা! দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরি। বাইজীদের রুমগুলো আগের মতোই; শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে আগুনের ব্যবস্থা আছে। সাহেবদের রুচিবোধ দেখে অবাক না হয়ে পারিনা, সুখ যাপনের নানাবিধ বিধি-ব্যবস্থা! আভিজাত্যের স্মারক হিসেবে কুঠির দেওয়ালে বাঘ ও হরিণের চামড়া টাঙানো রয়েছে। ধূর্ত ইংরেজরা বাঘের মতোই ক্ষিপ্র ও ভয়ঙ্কর। আশেপাশের গ্রামগুলোতে অসংখ্য কুঠি আছে। বৃটিশ শাসনের অন্ধকার দিক উন্মোচনের জন্য কুঠিগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। স্থানীয় চাষীদের তারা নীল চাষে বাধ্য করতো। রাজি না হলে ধরে এনে কুঠির অভ্যন্তরে আটকে রেখে নির্যাতন করতো। পাশেই মৃত্যকূপ। কাউকে কাউকে সেখানে নিক্ষেপ করতো। নীল চাষে বাধ্য করতে অভিনব শাস্তির বিধান ছিল। অবাধ্য চাষীকে ধরে খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধতো। মাথা টাক করে কাঁদা লেপ্টে তাতে নীলের বীজ বপন করতো। প্রতিকী শাস্তি। ইংল্যা-ের শিল্পবিপ্লবের কারণে নীলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইংরেজ সাহেবদের নীলে ধোঁয়া সাদা পোশাক দেখলে ঘেন্না হয় আমার। মনে হয় পোশাকের সাথে লেপ্টে আছে পূর্বপুরুষের লালরক্ত!
কাজলার তখন ভরা যৌবন। তার বুকে ভেসে ভেসে বড় নৌকা ও স্টিমার কলকাতা বন্দরে নোঙর করতো। জনপদে উৎপাদিত নীল বোঝাই হয়ে চলে যেত ইংল্যান্ডের বন্দরগুলোতে। খরস্্েরাতা কাজলার সাথে বহির্বিশ্বের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে জন্য আমঝুপিকে তারা বেছে নিয়েছিল। এলাকাটি নির্জন ও গোপনীয়তার চাদরে মোড়া। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বোঝার উপায় থাকে না, আশেপাশে এমন স্থাপনা থাকতে পারে। আমঝুপির কদর ইংরেজরা বুঝেছিল। ইংরেজ বেনিয়া ও তাদের দোসর মীর জাফর আলী খান এখানে বসেই নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, পলাশীর যুদ্ধের গোপন নীল নকশা রচনা করেছিল।
কাজলীর চোখে যুদ্ধচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। একদিকে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অন্যদিকে নবাব ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাংলার দুর্দিনে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দেশীয় ষড়যন্ত্রের কারণে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে অসম লড়াই ছিল। নবাবের পঞ্চাশ হাজার সৈন্য (পঁয়ত্রিশ হাজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল) ৫৩টি কামানের বিপক্ষে ইংরেজদের মাত্র ৯টি কামান, ১০০ বন্দুকবাজ, ২,১০০ ভারতীয় সিপাহি ও ১০০০ ইউরোপীয় সৈন্য অংশ নিয়েছিল। বৃটিশ ইস্ট ই-িয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, মেজর গ্যান্ট, মেজর আইরি কুট, ক্যাপ্টেন গপ ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। পক্ষান্তরে নবাবের বিশাল বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন, মীর জাফর আলি খান, দেওয়ান মোহন লাল, মীর মদন, মঁশিয়ে সিনফ্রে, খুদা-ইয়ার লতিফ খান এবং রায়দুর্লভ।
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। দূর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে ১৩ জুন যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও ইংরেজদের পথ কেউ রোধ করলো না। ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি হয়। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষèবাগ আ¤্রকাননে তাঁবু গাড়েন। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমন করেন। প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে পাশ্ববর্তী আ¤্রকাননে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু কাজলার তীরে সম্পাদিত চুক্তির কারণে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। নূন্যতম সহায়তা পেলে মীর মদন একাই হয়তো ইংরেজ বাহিনীকে পরাজয়ে বাধ্য করতেন।

সেই থেকে কাজলা অভিশপ্ত। কারো কারো মতে, বাংলা ও বাঙালীর অভিশাপে যৌবন হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। কাজলকে দেখলে আমার মায়া হয়। জল না থাকলে নদীর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্য বিষয়ে কাজলীর তুলনায় আমি অজ্ঞ। বহুবছর আগের সৌন্দর্য সে দৃষ্টির সীমানায় হাজির করে। আমার অবাক হওয়ার পালা। ৪৩২ বছর আগে কাজলার জলে সে নাকি জাহাজ ডুবতে দেখেছে! আমি তার হেঁয়ালি বুঝতে পারি, নাকে আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলি, ধ্যাত, এসব আজগুবি কথা।
কাজলী তীব্র বেগে মাথা নাড়ে, না না কাজল সত্যি বলছি আমি। জাহাজডুবিতে অসংখ্য ভিনদেশী মারা গিয়েছিল।
ভিনদেশী কেনো?
আরে বাবা, ওই জাহাজে তো ভিনদেশীরা এসেছিল!
কথা যুক্তিহীন নয়। বাঙ্গালির জাহাজ কোথায়, ভিনদেশীরাই তো ডুববে! কিন্তু ওই দৃশ্য কাজলীর দেখার কথা নয়! তাহলে? সে কি মিথ্যে গল্প শোনাচ্ছে? মিথ্যে বলার বিষয় মেয়েটি অস্বীকার করে। তার যুক্তি ভিন্ন- এই যে বুদ্ধু, চোখ বন্ধ করে অতীতের পানে হাঁটলে অনেক অজানাকে জানা সম্ভব। প্রাণপনে পথ হাঁটি আমি। কাজলামুখি হয়ে চোখ বন্ধ করে অতীতের পথে পা বাড়াই। কিন্তু বেশি দূর এগুতে পারি না, একাত্তরে আটকে থাকি। পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়া নিয়ে হতাশায় ডুবলে সে আলোর পথ দেখায়। খানিক দূরেই মুজিবনগরের আ¤্রকানন।
বুঝলে মশাই, একাত্তরের আকাশে এই জনপদেই আবার স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়েছিল।
হুম, ঠিক বলেছে সে। পলাশী থেকে মুজিবনগরের দুরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। আমার ভাবনার দুয়ার ক্রমপ্রসারিত। মাঝে মাঝে হতাশা ভর করে। কিছু বিষয়ে হেঁয়ালি ভালো লাগে না। কাজলা বিষয়ে তো নয়ই। কাজলার টানে জীবনের অনেক সঙ্গ উপেক্ষা করেছি। রাত নামলেই পায়ে পায়ে নীলকুঠি ও কাজলার তীরে এসে দাঁড়াই। অপরুপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। নদী শীর্ণকায় হলেও দুপাশের দৃশ্যাবলী মুগ্ধকর। অতএব নদীর সৌন্দর্য দেখতে পাঁচশো বছর আগে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যায়, গল্পের ছলে অনেক পথ পাড়ি দেয় সে। উহ, কথা বলতেও পারে! কথার মধ্যে বাতাস ঠোকার উপায় নেই। কথার সাথে হাত ও মাথা নাড়ে। জীবন বিষয়ে নানামুখি পরামর্শ দেয়। মুখ টিপে হাসি আমি, মাস্টার হলে বেশ মানাবে।
তাই!
হুম।
তাহলে দাও না একটি চাকরি। কতোদিন আর সংসারের বোঝা হয়ে থাকবো?
কাজলীর সংসার বিষয়ে আমি অজ্ঞ। শুনেছি ধারে কাছে কোথাও বাড়ি। কিন্তু যাওয়ার কথা বলেনি কখনো। কাজলীকে ইদানিং সন্দেহ। মেয়েটি আসলে কে! আমার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জোগাড় করলো কিভাবে? পৃথিবীটা মস্ত বড় ধাঁধাঁ। কাজলী ধাঁধা ছড়িয়ে চলে। ৫ম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমি যে গাছ থেকে পড়ে ঠ্যাং ভেঙেছিলাম সে কথাও তার অজানা নয়। পাশে ছোটখালার বাসা, সেখান থেকে জানলো নাকি! শক্ত করে দ’ুকাঁধ চেপে ধরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কে তুমি?
হাসির দমকে কাজলী গড়িয়ে পড়ে। বাতাসে চুল উড়িয়ে জানায়, আমি কাজলী বালক! দেখছো না, আমার চোখে মায়ার কাজল!
তাঁর দুচোখ সত্যি সত্যি মায়াময়। কেমন ভয় ভয় লাগে। কাজলা থেকে কাজলী- বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় অন্তর দুলে ওঠে। কাজলাকে যে রূপে কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেই রূপে কাজলী আমাকে ধরা দিয়েছিল! কোথাও বোধহয় ভুল হয়েছে। কিংবা কাজলার মোহে বুঝ-অবুঝের সমীকরণ মগজে আসেনি। প্রথম পরিচয়ের কথা স্মরণে আনলে কাজলীকে পরীমেয়ে ভাবতেই সহজ হয়। ভরা পূর্ণিমায় তাকে প্রথম দেখেছিলাম। মেয়েলি কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অপরিচিত জনপদ। বিশেষ কারো সাথে চেনাজানা নেই। অফিসের ব্যস্ততা শেষ হলে, রাত্রি গভীর হলে, ধীর পায়ে নির্জনে চলে আসি। পা ছড়িয়ে নদীতীরে বসে থাকি। কাজলার প্রতি গভীর টান অনুভব করি। তার সংস্পর্শ বুকে হাহাকার জাগে। মনে হয়, শিকড়ের খোঁজে নারীর কাছে এসেছি। কুঠির মাঝখানে প্রশস্ত হলরুম। তার নিচে যে গোপন কুঠুরি, যেখানে বসে মীর জাফর ও ইংরেজরা চক্রান্ত করেছিল ঠিক সেখানেই মেয়েটিকে আবিস্কার করি। চোখেমুখে অস্থিরতা; কাতরতা। আমাকে দেখতেই খানিকটা সরে আসে। অসংকোচে ভয়ার্ত পরিবেশ বর্ণনা করে। কিন্তু আমার মাথায় সেসব কথা ঢুকছিল না, অপলক দৃষ্টিতে তার চাঁদমুখ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম- নারী এতো অপরূপা হয়! কপালের লাল টিপ দেখে ভুল করেছিলাম। মনে হয়েছিল, নদী ফিরে এসেছে নারী হয়ে; পরীমেয়ে!
আমি ফিরে পেয়েছিলাম দুরন্ত কৈশোর। কাজলীর হাতে হাত রেখে অস্থির হয়ে উঠতাম। পায়ে পায়ে পাড়ি দিতাম দূরের পথ। নাহ, ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করতো না। কাজলার তীরে কাজলীর চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতাম। মনে হতো তাকে ছাড়া চলবে না।
দহনকাল।
নিজের মধ্যে অহর্ণিশ দহন। কাজলী নেই; কাজলী কাল¯্রােতে ভেসে গেছে। বিশ্বাসহীনতায় মেয়েটি কষ্ট পেয়েছিল। তার হৃদয়ের অন্তঃপুরে রাজ্যের অভিমান জমা হয়েছিল। অভিমানে কাঁদে। আড়ালে-আবডালে দীর্ঘশ্বাস ঝরায়। আমি বিশেষ পাত্তা দিই না, কৌশলে নিজেকে সরিয়ে রাখি, ব্যাস্ততার ভান করি। তখনো জানতাম না মেয়েটি আমায় ফাঁকি দেবে! ঘোর অন্ধকারে একা রেখে চলে যাবে! চলে গেছে সে; যে পথ দিয়ে এসেছিল সে-পথেই ফিরে গেছে। অথচ আমি যেতে পারি না; যাওয়া হয় না। কেউ একজন পথ রোধ করে দাঁড়ায়। মায়ার কাজল পরে বিভ্রান্ত করে!

প্রকাশ কাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ ও নামলিপি : গৌতম ঘোষ
মুদ্রণ : কালের ডাক অফসেট প্রেস, চকবাজার, শেরপুর।
সম্পাদনা পর্ষদ : রবিন পারভেজ, বিপুল দাম হৃদয়, দুপুর মিত্র।

যোগাযোগ : বিপুল দাম হৃদয়, সাতানীপাড়া (বৌ-বাজার), শেরপুর সদর, শেরপুর। মোবাইল : ০১৭১০-৯২৭৭২৮, E mail: mitra_bibhuti@yahoo.com ম্যাগাজিনটি কপিলেফ্ট। বিক্রির জন্য নয়। এই ম্যাগাজিনের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই ম্যাগাজিনের যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন।