পিন্টু রহমান
সাক্ষাৎকার
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
কাল বা সময়কে উত্তীর্ণ করার মধ্যে গল্পের শিল্পমান নিহিত। প্রকার-প্রকরণ কিংবা আঙ্গিক নয়, বিষয়বস্তুর নিরিখে যেসব গল্প কালোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলোই শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
বস্তুত সময়কে ধারণ করেই শিল্প-সাহিত্য। তবে ব্যক্তিভেদে ধারণের কৌশলে ভিন্নতা রয়েছে। সমকালীন সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় কুসংস্কার,
ইতিহাস-ঐতিহ্য,
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচারণসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ আমার গল্পের অনুসঙ্গ। মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান আমি। কৈশরের দিনগুলোতে যেসব গল্প বাবা-মার মুখে শ্রবণ করেছি পরবর্তীতে ওইসব কাহিনী আমার লেখকসত্ত্বায় রেখাপাত করেছে- হয়তো এ-কারণেই উল্লেখিত বিষয় আমার লেখা গল্পে আলোচ্য হিসেবে এসেছে।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
গল্পে নিরীক্ষা করার সুযোগ খুব বেশি একটা আছে বলে মনে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরীক্ষার নামে আমরা যা করি তা আসলে পরিবেশনের কৌশল; গল্প বলার কৌশল। সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসভিত্তিক গল্প রচনার ব্যাপারে নিজের মধ্যে বিশেষ তাড়না বোধ করছি। ইতিহাসের পাত্র-পাত্রী,
স্থান-কাল অক্ষুন্ন রেখে সংলাপের মাধ্যমে পাঠককে বিশেষ আবহের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা! ‘দহনকাল’ শিরোনামের গল্পটি তদ্রুপ- পলাশীর প্রান্তরের ঐতিহাসিক পেক্ষাপট তুলে ধরেছি।
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বাংলা গল্পের ইতিহাস গৌরবজনক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে জন্ম নেওয়া সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটি সমৃদ্ধির পথে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। গল্পের বিকাশধারা বাধাগ্র¯থ হওয়ার মতো ঘটনা অন্তত আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে হা, গত ১৫/২০ বছর শুধু গল্প নয় সাহিত্যের অন্য মাধ্যমও বিষয় হিসেবে সমকালীন রাজনীতি, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয় ও শাসকশ্রেণীর কর্মকান্ড কৌশলে এড়িয়ে চলছি- যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। যত দ্রুত সম্ভব এ অবস্থার উত্তরণ করতে হবে। তা না হলে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক বিকাশধারা ব্যাহত হবে।
দহনকাল
কাজলা ও কাজলীর প্রেমিক আমি! দুজনকেই ভালোবাসি। নাহ,
মেয়েতে মেয়েতে বিদ্বেষ নেই, ক্ষোভ-আক্ষেপ নেই, গ্লানি যা তা শুধু আমার! বন্ধুরা বলে, চমৎকার কাহিনী! এ নিয়ে জমজমাট সিনেমা হতে পারে। হয়ই তো! আমার গল্পে গান আছে, পাত্র-পাত্রী আছে, অসংখ্য খলনায়ক, যাতনা আছে; আছে যৌনতাও! যৌনতা শিল্পের পর্যায়ে থাকলে আপত্তি ছিল না। মীর জাফররা যা করেছিল তা বলাৎকার! অসম দেহ, মন ও বয়সের বলাৎকার। যৌবণ যতোই টসটসে হোক শরীরে কতই-বা সহ্য হয়; কাজলাও সইতে পারেনি, গলাকাটা মুরগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করেছে। রাতের নির্জনতায় দাঁতে ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। পশুদের পাশবিকতায় শরীরে লালরক্তের স্্েরাত। রক্তের ওই স্্েরাত কী সহজে থামতে চায়! শরীর নিংড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের শেষ বিন্দু যেখানে ঝরেছিল সেখানকার মাটি আজো অনুর্বর। নোনতা। কাজলার মুখের পানে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, মেয়েটি রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। চোখের নিচে কালি। চওড়া কপালে কলঙ্কের তীলক লটকে আছে। লাল রক্তের মতো টিপ দেখে পুনরায় ভুল করেছিলাম আমি।
দুর্ভাগ্য!
আর কতো মাশুল গুনবো!
নক্ষত্রের পানে চেয়ে চেয়ে ক্লান্তপ্রায়। কারণে অকারণে দীর্ঘশ্বাস ঝরে। কে আমার- কাজলা নাকি কাজলী? নাহ, কিনারা করতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, রিক্ত, শূন্য আমি। কতিপয় ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। বিরহের সজ্জায় এপাশ-ওপাশ করি। অভিমান ভুলে কাজলীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করি। মানুষের ভুল হয়, ভুল করে; আমিও ভুল করেছি।
আহা, মেয়েটি আমায় গল্প শুনিয়েছে!
চাঁদের আলোয় পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমের ছায়া মাড়িয়েছে! চোখের সম্মুখে বিস্তীর্ণ আ¤্রকানন। কুয়াশার চাদঁর মাড়িয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালে ক্ষণকালের জন্য চুপ হয়ে যেত। দূরের গ্রামগুলোর পানে চেয়ে থাকতো। কাজলার জন্য মায়া হতো তখন। কাজলীও সম্ভবত কাজলাকে অপছন্দ করতো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বুঝলে মশাই, নদী দিয়ে কতো স্্েরাত যে বয়ে গেছে!
¯্র্েরাত আমি দেখিনি তবু বলি, হুম, জানি তো। ধূর পাগল তুমি কিভাবে জানবে?
কাজলীর মুখে পাগল ডাক শুনতে খুব ভালো লাগে। নিজের বিশ্বাসের ওপর জোর রেখে পুনরায় বলি, আরে বাবা, বললাম তো জানি আমি।
কাজলী বিশ্বাস করে না, হেঁয়ালি করছো কাজল?
আমি মাথা নাড়ি, না।
মেয়েটির চোখেমুখে তখন কৌতুহলের ছায়া- আর কি কি জানো তুমি?
পড়া না-পারা বালকের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি। কাজলী ইতিহাসের পাঠ শেখায়, আহা,
নদীর স্্েরাতে অসংখ্য লাশ ভেসে গেছে। কতো মানুষ নিঃস্ব হয়ে নদীপাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে ঘর বেঁধেছে। ওই যে, সামনে যে গ্রামটি দেখছো, ওটা ছিল ভয়ঙ্কর জঙ্গল। ঘরহারা এক মাঝি প্রথম কুঁড়ে তুলেছিল।
তারপর!
প্রথম কুঁড়েটা লক্ষ্য করে দু’একজন করে আসতে লাগলো, বেড়ে চললো সীমানা; এখন তো মস্ত বড় একটা গ্রাম! অথচ আফসোস কী জানো, ওই মাঝির কথা আজ আর কারো মনে নেই!
মাঝির কথা ভেবে মনের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হয়। মনে মনে ভাবি, ঘরহীন মাঝি-মল্লারাই জনপদের নির্মাতা! কাজলী একাত্তরের কথা শোনায়। আমি যেতে চাই আরো পিছনে। ভগীরথির তীরে পলাশীর প্রান্তরে। কাজলার বুকে কান পাতলে ঘোড়ার পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুরের আঘাতে ধূলো উড়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঘোড়াগুলো কার; যাচ্ছেই বা কোথায়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও তার বাহিনী, মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা অভিমুখে ছুঁটে চলেছে। ইস,
অল্পের জন্য মীর জাফর আলী রক্ষা পেয়েছে। কুঠুরির খবর জানলে আস্ত রাখতো না।
আহা, নবাব যদি ওই কুঠুুরির খবর জানতেন!
কাজলার প্রতি সাময়িক অভিমান হয়। সে নিজেও গোপন কুঠুুরীর প্রত্যক্ষদর্শী। ফিসফিস করে খবরটা যদি নবাবের কানে পৌঁছাতো,
বাংলার স্বাধীনতা বিপণœ হতো না। যেদিন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না সেদিন উচ্চস্বরে গালমন্দ করি- বেইমান!
মীরজাফর!
স্বদেশের সাথে বেঈমানী করতে তোর বুক কাঁপলো না! আর কতো অভিশাপ কুড়াবি। অভিশাপের আগুন তোকে ক্ষমা করবে না। তোর জন্যই কাজলা আজ অভিশপ্ত। আরে বেইমান, বীর মরে একবার আর তোকে মরতে হবে লক্ষ-কোটিবার! ভেবেছিলি মরে বাঁচবি, তাইনা? মরেও শান্তি নেই। থুতু ছিটাই তোর নামে।
দ্রোহের আগুন লর্ড ক্লাইভকেও স্পর্শ করে। নীলকুঠির স্থাপনায় লাত্থি মারি, শুয়োরের বাচ্চা ইংরেজ বেনিয়া! এ মাটির সন্তান বদলা নিয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে হলেও দেশ থেকে উৎখাত করেছে। আরে বাপু, এতই যদি বাহাদুর তো লেজ গুটিয়ে পালালি ক্যান!
আমি রাগলে কাজলী নিরব হয়ে যায়। অবাক হয়ে চোখের পানে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে হোঁচট খায় বোধহয়। চেনা মানুষটাকে খুব বেশি অচেনা লাগে। মন-মেজাজ তিরিক্ষি না থাকলে নতুন গল্প শোনায়। অভিশপ্ত কাজলার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বর্ণনা করে- মেহেরপুর জনপদের পরিচিতি মুখ সে; কাজলা নদী। ¯্রােত হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। দু’পাশে বিস্তির্ণ চর। একদা যেখানে মাছেদের অভয়ারণ্য ছিল সেখানেই আজ চাষীদের ঘরবসতি। ঘরের পাশ ঘেঁষে ফসল; পূবালী বাতাসে ফসলের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায়। পাটের বাড়ন্ত ডগাগুলো যেনো নেচে নেচে কুর্ণিশ করে! মাঝিয়ালদের বিবমিষা। কাজলার রূপ-লাবণ্য কেবলি ইতিহাস। মাথাভাঙ্গার শাখানদী সে। কাজিপুর ইউনিয়নে মাথাভাঙ্গা থেকে বেরিয়ে নপাড়া, ভাটপাড়া,
সাহারবাটি,
গাড়াডোব হয়ে আমঝুঁপিতে বাঁকবদল করে ভৈরবে পতিত হয়েছে। কথিত আছে, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্যে মোঘল সেনাপতি মানসিংহ ১৫৮৯ সালে নদীপথে মেহেরপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন। শুধু সেনাপতি নয় স্বয়ং নবাবের পায়ের ধূলো পেয়ে জনপদ ধন্য। ১৭৫০ সালে নবাব আলিবর্দী খাঁ নদীপথে মেহেরপুরে আসেন। দুর্যোগ কবলিত হয়ে রাজু গোয়ালিনী নামের নামগোত্রহীন এক বিধবার আতিথ্য গ্রহণ করেন। নদীটি অসংখ্য ঘটনার সাক্ষি; পাথরচোখে অনেক ভাঙাগড়া অবলোকন করেছে!
াজলীর চোখে জল; ইতিহাসের পাতায় পাতায় জলের ধারা। কাজলার সংস্পর্শে ইদানিং নেশাগ্রস্ত। নেশার ঘোরে পথ হারাই। জলে নামি। দূর থেকে ভেসে আসে মুর্শিদি,
মারফতি,
ভাওয়াইয়া,
রাখালিয়া গানের সুর! উদাস করা সুরে প্রাণ আকূল হয়ে ওঠে। এ সুরের উৎস কোথায়! ঘাটের সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে চারপাশে লক্ষ্য করি। কখনো মনে হয়, এইতো কাছেই; বাগানের মধ্যে কেউ একজন বাঁশিতে সুর তুলেছে। সুরের মূর্ছনায় আসমান-জমিন একাকার! হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত, শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। তথাপি শিল্পী ও সুরের উৎসে বিভ্রান্ত হই। মাঝে মাঝে এও মনে হয়, বোধহয় জ্বীন-পরীদের খপ্পরে পড়েছি।
আমঝুপির জীবনে আমূল বদলে গেছি। অন্য কারো সান্নিধ্য ভালো লাগে না। পায়ে পায়ে কাজলার তীরে হাজির হই। আনমনে কথা বলি। কুঠির আশেপাশে পায়চারি করি। ঘাটের সিঁড়িতে বসে হা-পিত্যেশ করি। সিঁড়িটাও অভিশপ্ত। নীলকরদের বহনকারী নৌযান ঘাটে নোঙর ফেলতো। তারপর অট্টহাসির কলোরোল মুখে নিয়ে অন্দরমহলে! ভগ্নপ্রায় দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই হাসি কানে বাজে। উফ,
কী বিভিষীকা! দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরি। বাইজীদের রুমগুলো আগের মতোই; শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে আগুনের ব্যবস্থা আছে। সাহেবদের রুচিবোধ দেখে অবাক না হয়ে পারিনা, সুখ যাপনের নানাবিধ বিধি-ব্যবস্থা!
আভিজাত্যের স্মারক হিসেবে কুঠির দেওয়ালে বাঘ ও হরিণের চামড়া টাঙানো রয়েছে। ধূর্ত ইংরেজরা বাঘের মতোই ক্ষিপ্র ও ভয়ঙ্কর। আশেপাশের গ্রামগুলোতে অসংখ্য কুঠি আছে। বৃটিশ শাসনের অন্ধকার দিক উন্মোচনের জন্য কুঠিগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। স্থানীয় চাষীদের তারা নীল চাষে বাধ্য করতো। রাজি না হলে ধরে এনে কুঠির অভ্যন্তরে আটকে রেখে নির্যাতন করতো। পাশেই মৃত্যকূপ। কাউকে কাউকে সেখানে নিক্ষেপ করতো। নীল চাষে বাধ্য করতে অভিনব শাস্তির বিধান ছিল। অবাধ্য চাষীকে ধরে খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধতো। মাথা টাক করে কাঁদা লেপ্টে তাতে নীলের বীজ বপন করতো। প্রতিকী শাস্তি। ইংল্যা-ের শিল্পবিপ্লবের কারণে নীলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইংরেজ সাহেবদের নীলে ধোঁয়া সাদা পোশাক দেখলে ঘেন্না হয় আমার। মনে হয় পোশাকের সাথে লেপ্টে আছে পূর্বপুরুষের লালরক্ত!
কাজলার তখন ভরা যৌবন। তার বুকে ভেসে ভেসে বড় নৌকা ও স্টিমার কলকাতা বন্দরে নোঙর করতো। জনপদে উৎপাদিত নীল বোঝাই হয়ে চলে যেত ইংল্যান্ডের বন্দরগুলোতে। খরস্্েরাতা কাজলার সাথে বহির্বিশ্বের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে জন্য আমঝুপিকে তারা বেছে নিয়েছিল। এলাকাটি নির্জন ও গোপনীয়তার চাদরে মোড়া। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বোঝার উপায় থাকে না, আশেপাশে এমন স্থাপনা থাকতে পারে। আমঝুপির কদর ইংরেজরা বুঝেছিল। ইংরেজ বেনিয়া ও তাদের দোসর মীর জাফর আলী খান এখানে বসেই নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, পলাশীর যুদ্ধের গোপন নীল নকশা রচনা করেছিল।
কাজলীর চোখে যুদ্ধচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। একদিকে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অন্যদিকে নবাব ও ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাংলার দুর্দিনে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দেশীয় ষড়যন্ত্রের কারণে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে অসম লড়াই ছিল। নবাবের পঞ্চাশ হাজার সৈন্য (পঁয়ত্রিশ হাজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল) ৫৩টি কামানের বিপক্ষে ইংরেজদের মাত্র ৯টি কামান, ১০০ বন্দুকবাজ, ২,১০০ ভারতীয় সিপাহি ও ১০০০ ইউরোপীয় সৈন্য অংশ নিয়েছিল। বৃটিশ ইস্ট ই-িয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন,
কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, মেজর গ্যান্ট, মেজর আইরি কুট, ক্যাপ্টেন গপ ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। পক্ষান্তরে নবাবের বিশাল বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন, মীর জাফর আলি খান, দেওয়ান মোহন লাল, মীর মদন, মঁশিয়ে সিনফ্রে, খুদা-ইয়ার লতিফ খান এবং রায়দুর্লভ।
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। দূর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে ১৩ জুন যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও ইংরেজদের পথ কেউ রোধ করলো না। ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি হয়। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষèবাগ আ¤্রকাননে তাঁবু গাড়েন। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমন করেন। প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে পাশ্ববর্তী আ¤্রকাননে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু কাজলার তীরে সম্পাদিত চুক্তির কারণে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। নূন্যতম সহায়তা পেলে মীর মদন একাই হয়তো ইংরেজ বাহিনীকে পরাজয়ে বাধ্য করতেন।
সেই থেকে কাজলা অভিশপ্ত। কারো কারো মতে, বাংলা ও বাঙালীর অভিশাপে যৌবন হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। কাজলকে দেখলে আমার মায়া হয়। জল না থাকলে নদীর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্য বিষয়ে কাজলীর তুলনায় আমি অজ্ঞ। বহুবছর আগের সৌন্দর্য সে দৃষ্টির সীমানায় হাজির করে। আমার অবাক হওয়ার পালা। ৪৩২ বছর আগে কাজলার জলে সে নাকি জাহাজ ডুবতে দেখেছে! আমি তার হেঁয়ালি বুঝতে পারি, নাকে আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলি, ধ্যাত, এসব আজগুবি কথা।
কাজলী তীব্র বেগে মাথা নাড়ে, না না কাজল সত্যি বলছি আমি। জাহাজডুবিতে অসংখ্য ভিনদেশী মারা গিয়েছিল।
ভিনদেশী কেনো?
আরে বাবা, ওই জাহাজে তো ভিনদেশীরা এসেছিল!
কথা যুক্তিহীন নয়। বাঙ্গালির জাহাজ কোথায়, ভিনদেশীরাই তো ডুববে! কিন্তু ওই দৃশ্য কাজলীর দেখার কথা নয়! তাহলে? সে কি মিথ্যে গল্প শোনাচ্ছে? মিথ্যে বলার বিষয় মেয়েটি অস্বীকার করে। তার যুক্তি ভিন্ন- এই যে বুদ্ধু, চোখ বন্ধ করে অতীতের পানে হাঁটলে অনেক অজানাকে জানা সম্ভব। প্রাণপনে পথ হাঁটি আমি। কাজলামুখি হয়ে চোখ বন্ধ করে অতীতের পথে পা বাড়াই। কিন্তু বেশি দূর এগুতে পারি না, একাত্তরে আটকে থাকি। পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়া নিয়ে হতাশায় ডুবলে সে আলোর পথ দেখায়। খানিক দূরেই মুজিবনগরের আ¤্রকানন।
বুঝলে মশাই, একাত্তরের আকাশে এই জনপদেই আবার স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়েছিল।
হুম, ঠিক বলেছে সে। পলাশী থেকে মুজিবনগরের দুরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। আমার ভাবনার দুয়ার ক্রমপ্রসারিত। মাঝে মাঝে হতাশা ভর করে। কিছু বিষয়ে হেঁয়ালি ভালো লাগে না। কাজলা বিষয়ে তো নয়ই। কাজলার টানে জীবনের অনেক সঙ্গ উপেক্ষা করেছি। রাত নামলেই পায়ে পায়ে নীলকুঠি ও কাজলার তীরে এসে দাঁড়াই। অপরুপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। নদী শীর্ণকায় হলেও দুপাশের দৃশ্যাবলী মুগ্ধকর। অতএব নদীর সৌন্দর্য দেখতে পাঁচশো বছর আগে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যায়, গল্পের ছলে অনেক পথ পাড়ি দেয় সে। উহ,
কথা বলতেও পারে! কথার মধ্যে বাতাস ঠোকার উপায় নেই। কথার সাথে হাত ও মাথা নাড়ে। জীবন বিষয়ে নানামুখি পরামর্শ দেয়। মুখ টিপে হাসি আমি, মাস্টার হলে বেশ মানাবে।
তাই!
হুম।
তাহলে দাও না একটি চাকরি। কতোদিন আর সংসারের বোঝা হয়ে থাকবো?
কাজলীর সংসার বিষয়ে আমি অজ্ঞ। শুনেছি ধারে কাছে কোথাও বাড়ি। কিন্তু যাওয়ার কথা বলেনি কখনো। কাজলীকে ইদানিং সন্দেহ। মেয়েটি আসলে কে! আমার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জোগাড় করলো কিভাবে? পৃথিবীটা মস্ত বড় ধাঁধাঁ। কাজলী ধাঁধা ছড়িয়ে চলে। ৫ম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমি যে গাছ থেকে পড়ে ঠ্যাং ভেঙেছিলাম সে কথাও তার অজানা নয়। পাশে ছোটখালার বাসা, সেখান থেকে জানলো নাকি! শক্ত করে দ’ুকাঁধ চেপে ধরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম,
কে তুমি?
হাসির দমকে কাজলী গড়িয়ে পড়ে। বাতাসে চুল উড়িয়ে জানায়, আমি কাজলী বালক! দেখছো না, আমার চোখে মায়ার কাজল!
তাঁর দুচোখ সত্যি সত্যি মায়াময়। কেমন ভয় ভয় লাগে। কাজলা থেকে কাজলী- বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় অন্তর দুলে ওঠে। কাজলাকে যে রূপে কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেই রূপে কাজলী আমাকে ধরা দিয়েছিল! কোথাও বোধহয় ভুল হয়েছে। কিংবা কাজলার মোহে বুঝ-অবুঝের সমীকরণ মগজে আসেনি। প্রথম পরিচয়ের কথা স্মরণে আনলে কাজলীকে পরীমেয়ে ভাবতেই সহজ হয়। ভরা পূর্ণিমায় তাকে প্রথম দেখেছিলাম। মেয়েলি কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অপরিচিত জনপদ। বিশেষ কারো সাথে চেনাজানা নেই। অফিসের ব্যস্ততা শেষ হলে, রাত্রি গভীর হলে, ধীর পায়ে নির্জনে চলে আসি। পা ছড়িয়ে নদীতীরে বসে থাকি। কাজলার প্রতি গভীর টান অনুভব করি। তার সংস্পর্শ বুকে হাহাকার জাগে। মনে হয়, শিকড়ের খোঁজে নারীর কাছে এসেছি। কুঠির মাঝখানে প্রশস্ত হলরুম। তার নিচে যে গোপন কুঠুরি, যেখানে বসে মীর জাফর ও ইংরেজরা চক্রান্ত করেছিল ঠিক সেখানেই মেয়েটিকে আবিস্কার করি। চোখেমুখে অস্থিরতা;
কাতরতা। আমাকে দেখতেই খানিকটা সরে আসে। অসংকোচে ভয়ার্ত পরিবেশ বর্ণনা করে। কিন্তু আমার মাথায় সেসব কথা ঢুকছিল না, অপলক দৃষ্টিতে তার চাঁদমুখ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম-
নারী এতো অপরূপা হয়! কপালের লাল টিপ দেখে ভুল করেছিলাম। মনে হয়েছিল, নদী ফিরে এসেছে নারী হয়ে; পরীমেয়ে!
আমি ফিরে পেয়েছিলাম দুরন্ত কৈশোর। কাজলীর হাতে হাত রেখে অস্থির হয়ে উঠতাম। পায়ে পায়ে পাড়ি দিতাম দূরের পথ। নাহ,
ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করতো না। কাজলার তীরে কাজলীর চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতাম। মনে হতো তাকে ছাড়া চলবে না।
দহনকাল।
নিজের মধ্যে অহর্ণিশ দহন। কাজলী নেই; কাজলী কাল¯্রােতে ভেসে গেছে। বিশ্বাসহীনতায় মেয়েটি কষ্ট পেয়েছিল। তার হৃদয়ের অন্তঃপুরে রাজ্যের অভিমান জমা হয়েছিল। অভিমানে কাঁদে। আড়ালে-আবডালে দীর্ঘশ্বাস ঝরায়। আমি বিশেষ পাত্তা দিই না, কৌশলে নিজেকে সরিয়ে রাখি, ব্যাস্ততার ভান করি। তখনো জানতাম না মেয়েটি আমায় ফাঁকি দেবে! ঘোর অন্ধকারে একা রেখে চলে যাবে! চলে গেছে সে; যে পথ দিয়ে এসেছিল সে-পথেই ফিরে গেছে। অথচ আমি যেতে পারি না; যাওয়া হয় না। কেউ একজন পথ রোধ করে দাঁড়ায়। মায়ার কাজল পরে বিভ্রান্ত করে!
No comments:
Post a Comment