Total Pageviews

হামিম কামাল এর সাক্ষাৎকার ও গল্প


হামিম কামাল

সাক্ষাৎকার
 
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
আমার মনে হয়, গল্পের শিল্প তার উদ্দেশ্যহীনতায়
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
আমি সামান্য মানুষগল্পলেখার ক্ষেত্রে আমি গল্পকে প্রাধান্য দিই
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
সত্যি বলতে কী, ব্যাপারগুলো আমার নিজের কাছেও ঠিক ব্যাখ্যা করার মতো স্পষ্ট নয় তবে, আমার কিছু ব্যক্তিগত দার্শনিক বোঝাপড়াকে গল্পের আকার দিতে চেয়েছি, এটুকু বলতে পারি
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফর্ম, স্টাইল এসবকে স্রেফ টুলস হিসেবে দেখি, আর কিছু না আর টুলস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তো বটেই লেখক হলেন মুক্ত ইচ্ছার মনু তার সংহিতা পরিবর্তনশীল তার নিরীক্ষারকিভাবেওই ব্যক্তিগত মনুসংহিতার নির্দেশনায় বাঁধা অগণিত মৌলিককিভাবেকে একটা সাধারণ পাটাতনে দাঁড় করিয়ে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই
তবে; গল্পের আত্মার সঙ্গে যার বোঝাপড়া ভালো তিনি হয়ত আগে আলাপটা সেরে নিয়েছেন যে, ‘বন্ধু, তুমি তো এমন, তোমাতে অমন প্রয়োগি?’ আত্মা বলেছে, ‘বেশ তো!’
আর যাদের বোঝাপড়া ভালো না, তারা গল্পের সঙ্গে টুলসবাজি করতে যাওয়ামাত্র গল্প তাদের ডিভোর্স দিয়েছে
নিরীক্ষা সফল বা ব্যর্থ হয়কিভাবে’, তার কোনো সূত্র হয়ত এতে আছে
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বিনীত; যতদিন করোটির ভেতর বস্তু থাকবে, বস্তুর ভেতর ধূসর অংশ থাকবে, ততদিন শুধু গল্প কেন, শিল্পের একটা মাধ্যমেরও বিকাশএকটি পর্যায়ে এসেথেমে যাওয়ার কোনো সার্বিক সম্ভাবনা নেই

ফাঁদ

বৃদ্ধ বলল, ‘কী, কোনো শব্দ কানে আসে? পুলিশ লাইন তো খুব বেশি দূরে নাতার চোখে কৌতুক দূরে ছাড়া ছাড়া গুলির শব্দ আর থেকে থেকেই অনেক মানুষের স্বর এই শোনা যায়, এই দূরে সরে যায় 
তরুণী শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো বৃদ্ধের প্রশ্নেরআসেই তো তোমার আসছে না বুঝি!’
বৃদ্ধ মুখে চুপ, চোখে নয় ছাদ থেকে মেঝে সবখানে তার কৌতুকী চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে মনোভাব আড়াল করার কোনো ভদ্রতাসূচক চেষ্টাও তার নেই
মেয়েটা বলল, ‘আসছে না তার মানে অবশ্য আসার কথাও নয় এতো বছরের অনভ্যাস সেই কাঁচা চুলের কালে একবার দুবার শুনেছ এখন তো পাকা চুলের কাল
বৃদ্ধ হাত তুলে বলল, ‘যদি শুনতেই পেয়ে থাকো তো আর বাগাড়ম্বর কেন? চলো বেরিয়ে পড়ি, লোককে বলি লোকবল ছাড়া তো আর বিপ্লব হয় না
অবশ্য ঘুমানোর রাত এখনো পুরাটাই বাকি তোমার বিপ্লবীরা সবে মাত্র বিছানায় গেছে সবাই ডাক শুনে ক্ষেপে যাবে কেউ কেউ মাথা যদি তোলেও, ভাববে কোনো স্বপ্ন বুঝি একটা মুহূর্ত, ব্যাস! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়বে
তুমি দেখছি সেই তখন থেকেই...’ কথা শেষ না করেই থামল মেয়েটা সামলে নিয়ে বলল, ‘কাজটা ভালোই পারো বোধহয়
তা খোঁচা বুড়ো? তুমি তো আর শব্দটা শুনতে পারছ না, আসছে না তোমার কানে তাহলে এক আমাকে বেরোতে উসকে দিচ্ছো কেন? তোমার রহস্যটা পরিষ্কার করো তো? আমার কেমন গোলমেলে ঠেকছে
তুমি উভচর নও তো? যাকে বলে ডাবল এজেন্ট?
যদি হও তো হিসেবটা মেলে আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে হাওয়া বুঝে ধরিয়ে দিতে চাও
এসব ক্লিশে মেরো না জমছে না তোমার কৌতুক,’ বলল বৃদ্ধ
তোমারও নয় কৌতুকে রস থাকে বলে জানি তা আমোদের রসই থাকুক, কি করুণ রস তোমারটায় বিষ ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লো বিষও তরল হয়, কিন্তু তা নিশ্চয়ই রস নয়! তোমার কৌতুকটা ওই বিষে আক্রান্ত হয়ে নিজেই মরছে
আচ্ছা, এই তুমি ঘরে এসেছ কী কেবল আমাকে দুর্বল রে দিতে? তোমরা কেন কেবল বয়োঃবৃদ্ধই হলে? কেন বিদ্যাবৃদ্ধ হলে না? কী ক্ষতি ছিল?
তোমরা তো সীসা দিয়ে, ইস্পাত দিয়ে বিপ্লব করেছ; এজন্যেই তোমাদের মনে এতো হতাশা! কারণ, তোমরা কাজের ফলটা পেয়েছ হাতেনাতে এবং ভেবেছ- আহ! এই তো পাওয়া গেল! কিন্তু দেখো, ওই ফল হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ওই ফল অন্য পাখি এসে ঠুকরে খেয়ে গেছে ফল কি থাকে কখনো? কর্মফল সবসময় ক্ষয় হয় অক্ষয় হলো ফলের ধারণা
কী, ভুল বলেছি? আমার কথা ভুল হলে পাল্টা কথা বলো প্রতিযুক্তি দাও
বৃদ্ধের হাসি থেকে কৌতুকের চিহ্ন মুছে গেল লেগেছে
এমন সময় ছাদের এক কোণ থেকে একটা কালো মেঘ ধীরে এগিয়ে এলো একেবারে ঘরের মধ্যখানে মেঘের ভেতর ছোট ছোট বজ্র, নিজেদের ভেতর যেন খেলছে এক ফোঁটা দুফোঁটা করে ঝরতে থাকল জল বৃদ্ধের মাথার ওপর
বৃদ্ধ সরে দাঁড়ালে মেঘও জায়গা বদল করে ঠিক তার মাথার ওপরটাই বেছে নেয় বারবার
বৃদ্ধ অসহায় মুখ করে মেয়েটার দিকে তাকাল
মেয়ে       : ‘ভালো কথা এই ঘরে তুমি কী করে এলে ব্যাপারে কিছু জানো?’
বৃদ্ধ          : ‘আমি নিজেকে তো ঘরেই আবিষ্কার করেছি এর আগের ব্যাপারে তো কিছু জানি না তুমি জানো? তুমি এখানে এলে কী করে তা বলো দেখি, সেখানে আমার উত্তরটাও আছে কিনা
মেয়েটা বলল, ‘আমিও নিজেকে ঘরেই আবিষ্কার করেছি হঠাৎ
তুমি কি আমার মাথার ওপর মেঘটা দেখতে পারছ?’ বৃদ্ধ প্রশ্ন করল
হ্যাঁ, পারছি তো
তাহলে সরিয়ে দিচ্ছো না কেন!’
বেশ,’ বলে মেয়েটা এগিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা ঝুলঝাড় দিকে এগোতে থাকল
বৃদ্ধ খানিকটা ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘শব্দটা আমিও শুনেছি আসলে তোমাকে উসকে দিতে চাইছিলাম, ঠিকই বলেছ কিন্তু তাই বলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে কখনও না তোমাকে ধরিয়ে দিলে আমি থাকব? আমারও যৌবন ছিল বিশ^াসের
মেয়েটা ঝুলঝাড়হাতে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বৃদ্ধের মাথার ওপর থেকে মেঘটা সরিয়ে ধীরে ধীরে জানালার দিকে সেটিকে ঠেলে এগোতে থাকল
জানালাটা বাইরে থেকে বন্ধ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার বলল, ‘ওহ, আমি তো ভুলেই গেছি, জানালাটা বাইরে থেকে ওরা বন্ধ করে রেখেছে
তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোয়ালে দুয়ার রুদ্ধ ব্যর্থ ^াপদ হানা দিয়ে ফেরে রাতের শিকারি ক্রুদ্ধ তাহলে ঘরের ভেতরই থাক
আমার তো অসুবিধা নাইবৃদ্ধ বললমাথার ওপর না এলেই হলো
মেয়েটা জানালার ওপর ছাদের কাছে এক কোণে তুলে দিলো মেঘের স্তূপকে অদৃশ্য হয়েছে মেঘের ভেতর আলোর চাবুক জলপতনও বন্ধ হয়েছে
মেয়েটা ঘরের মাঝখানে পেতে রাখা চেয়ারের ওপর গিয়ে বসল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এবার আমি আমার নিয়মিত আরাধনায় বসলাম তুমি নিজের মতো সময় কাটাও ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো
আরাধনা? কার আরাধনা আবার!’ বৃদ্ধ বিস্মিত
কালের আরাধনা
কাল? এসব... শিখলে কোথায়!’ বৃদ্ধ যেন খুবই অবাক হয়েছে
আরাধনা তো শেখার কিছু নয় লো শোনো-
একই পৃথিবীতে বাস করলেও সবার ভেতরেই একেকটা আলাদা পৃথিবী তৈরি আছে, একেকটা আলাদা লোক, একেকটা আলাদা জগৎ তাই দেখো, মানুষ বোঝাতে এই তুমি বহুবার বলেছ, লোক প্রতিটা আলাদা আলাদা জগতের সঙ্গে আলাদা আলাদা সময় জড়ানো স্থান আর কাল জড়ানো কোনো লোককে ধ্বংস করা হলে ওই লোকের লোক ধ্বংস হয় মানে কালও ধ্বংস হয় এবার নিজ বুকে হাত রেখে দেখো, তুমিও একজন মানুষ, তুমিও আস্ত একটি লোক সুতরাং তোমার ভেতরও আছে কাল
কালের আরাধনা মানে কিন্তু প্রকারান্তরে নিজের ভেতরের ওই লোকের আরাধনা তাহলে কী দাঁড়াল?’
ঘরের এক কোণে একটা চাঁদকে ভাসতে দেখল বৃদ্ধ চাঁদটা যেন জলের ওপর ভাসতে থাকা শোলার নৌকা ধীরে ধীরে অল্প খানিক জায়গার ভেতর ওঠানামা করতে থাকল
হ্যাঁ? খুব কঠিন করে কথা বলো তুমিবৃদ্ধ বলল
মেয়েটা বলল, ‘অথচ গোটা পৃথিবীতে কিন্তু তরুণরাই উল্টো বৃদ্ধদের কথা বলে বলে, বড় কঠিন করে কথা বলেন তো আপনি! একটু সহজ করে বলতে পারেন না?’
বৃদ্ধ চুপ করে থেকে খানিক বাদে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমিও কিন্তু আমাকে অপমান করে কথা বলো
মেয়েটা হেসে বলল, ‘এসবকে গুরু মায়ের ভর্ৎসনা বলে নাও!’
বৃদ্ধ বলল, ‘তো আরাধনায় তো একটা কিছু আহুতি দেওয়ার দরকার হয় তুমি কী আহুতি দিচ্ছ?’
আমাকে আমি সমগ্র লোককে পাওয়ার সাধনা করছি প্রকারান্তরে, সমগ্র লোকের সঙ্গে জড়ানো কাল আমার আরাধনার বিষয় এবার দেখো, আমি, ব্যক্তি আমি একাই ব্যক্ত এর অর্থ আমার, ব্যক্তি-আমার ব্যক্ত লোকের সঙ্গে জড়ানো কালটা, অর্থাৎ আমার ব্যক্তিগত কালটা হলো গিয়ে ওই সামগ্রিক কালের কাছে আহুতি সামগ্রিক কালের ভেতর ব্যক্ত এই আমার কাল যখন লীন, তখন আমার উদ্দেশ্য সফল
আখেরে কী লাভ?’
তুমি লাভের আশায় আরাধনা কোরো না লাভের ফল স্থায়ী নয় কিন্তু আমার চাই স্থায়ী অর্জন তোমাকে খানিক আগে বলা আমার সব কথাই কি ব্যর্থ হলো তাহলে?
লাভের আশায় আরাধনা করলে, ফলের আশায় কাজ করলে লাভ তুমি পাবে, ফল তুমি পাবে, ঠিকই কিন্তু সেই ফল, সেই লাভ, ক্ষয়ও হয়ে যাবে তোমাকে তো অক্ষয় অশেষের দিকে যেতে হবে তুমি আরাধনা করবে প্রেমে ড়ে, যেন বিনিময়ে কিছু চাও না প্রেম তো ওভাবেই করতে হয় তুমি জানো না? তুমি কখনো প্রেমে পড়নি?’
বৃদ্ধ মুখ ঘুরিয়ে মনের ভেতরটা যেন গোছাতে লেগে গেলনা, আমি সেই অর্থে বলিনি
তুমি আসলে কী জানতে চাইছ দিনের শেষে আমার গন্তব্যটা কোথায়? উদ্দেশ্যটা কী এই পথচলা তো আর অর্থহীনতায় খামখেয়ালিতে ডুবতে পারে না তুমি একটা কোনো উদ্দেশ্য চাইছ উদ্দেশ্য চাইছ বলেই তুমি বারবার উদ্দেশ্য খোঁজ করছ তাই না?’
হয়ত হ্যাঁ অনেকটাই
অস্তিত্ব আছে বলেই অস্তিত্বের সংকট আছে সংকট আছে বলেই উত্তরণের শর্তে প্রেমের উৎপত্তি আরাধনা করে কালেও ওই প্রেমটাই চাই
প্রেমকে সমীকৃত করতে হিংসা আছে প্রেম আর হিংসার দ্বান্দ্বিকতা আছে
দুই পক্ষই সার্থক হয় তুমি কোন পক্ষে থেকে সার্থক হতে চাও তা কেবল বেছে নাও
ভারসাম্যের এই সব শর্ত আছে শর্ত আছে বলে শর্তভঙ্গের তাড়নাও আছে কী বুঝলে? সবশেষ অস্তিত্ব আছে বলে এই সব বোঝাপড়া আছে আর কারো কারো এই বোঝাপড়ার মাথাব্যথা আছে বলে কারো কারো তা নেই
বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু তুমি এতোটুকুন মেয়ে, এতো বোঝার বোঝা কী করে নিচ্ছো?’
কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা না থাকায় এসব বোঝাপড়া আমার কাছে পালকের মতো হালকা পাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকলে পাহাড়ের মতো ভারি
বৃদ্ধ বলল, ‘তোমার কি মনে হয় না এইসব ¯্রফে বড় বড় কথা এসব দিয়ে কি মাঠে ফসল ফলে? এসব কেমন যেন, কৃত্রিম, মনে হয় না? মনে হয় না, এসব বোঝাপড়া, কথাবার্তা আমাদের এই ক্ষুধায় পাওয়া একটা কেমন নির্মম জীবনের সামনে রীতিমতো হাস্যকর? এসব কথা কেমন জীবনকে ছাড়িয়ে যাওয়া, সম্পর্কহীনরকম বড় বড়, মনে হয় না এমন? 
মেয়েটা বলল, ‘আসলে দিনের শেষে কী হয় জানো? দিনের শেষে তোমার ওই ক্ষুধায় পাওয়া জীবনটা এসব কথার চেয়েও বড় বিস্ময়
হঠাৎ হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে মেয়েটা বলল, ‘দাঁড়াও, একমুহূর্ত! শুনতে পারছ? কী শব্দ আসছে ওই রাজারবাগ থেকে!
বৃদ্ধ বলল, ‘কী করলে তোমার কাজে আসব, বল আমি ক্ষমা চাই যে শুরুতে তোমার সাথে আমোদ করেছি সত্যিই আমরা অস্ত্র দিয়ে ফল ছিনিয়েছিলাম ফলও যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এই সাধারণ কথাটা মনে ছিল না তুমি কত সহজে ধরে দিলে
মেয়ে, তোমার সাথে একটু ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা ভাগ করে নিই, দেখো? ক্ষণে ক্ষণে আমার আলো টেনে নিতে চাইছে ওই কালো মেঘ’; বৃদ্ধ কালো মেঘের দিকে আঙুল তুলে দেখাল আবার দেখো, ক্ষণে ক্ষণে তা আমাকে আবার ফিরিয়ে দিতে চাইছে ওই চাঁদ’;
মেয়েটা যেন খুশি হয়ে উঠল তার চোখের পাতায় কিশোরীর চপলতা; বলল, ‘তুমি যদি আমার ওপর ক্ষমতা খাটাতে পারো, তো আমাকেও তোমার ওপর ক্ষমতা খাটাতে পারতে হবে যদি তুমি আর কেবল তুমিই আমার ওপর ক্ষমতাবান হও, আমি তোমার ওপর না হই, তাহলে কিন্তু প্রকৃতির শর্তই ভেঙে যায় তুমি কি আমার কথা ধরতে পারছ?’
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা চোখ বন্ধ করল পেছনে
জানালার বাইরে রাতের সড়কবাতির আলো ফুটে থাকল দূরে দূরে তার নিচে ফিতের মতো শুয়ে আছে ধূসর রাস্তা আলোর অল্পই পর্দাহীন কাচ গলে ভেতরে এলো
শহরের বসতি থেকে ছিটকে পড়া বাড়ি বড় পুরনো এর ধাঁচ কারা ছিল এখানে? কে জানে বাড়ির ইতিহাস অন্ধকারে ঢাকা 
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, ‘অন্ধকার ইতিহাসের জন্য ভালো অন্ধকার বৃষ্টির জন্য ভালো অন্ধকার চাঁদের জন্যে ভালো
ঘরের এক কোণে কালো মেঘের ভেতর মৃদু শব্দে চিড়চিড়িয়ে বিজলি ডাকল আবার বৃদ্ধের মাথার ওপর এবার আর এলো না
ঘরের অপর কোণে ভেসে থেকে আলো ছড়াতে থাকল চাঁদ আগের মতো ওঠানামায় নেই বরং স্থির
যতই বুড়ো হই, আমি আসলে মানুষ নতুনইবলল বৃদ্ধকারণ আমাকে এসব বলে দেওয়া হয় নাই আমার জানতে এতো দেরি হলো, এতো কাঠখড় পোড়াতে হলো, বোঝাপড়ায় আসতে এতোটা সময় আমার পার হয়ে গেল অথচ, অথচ আগামীকাল একটা শিশুও জানবে, ঈশ^ যদি মানুষের ওপর ক্ষমতাবান  হয়, তো মানুষেরও ঈশ^রের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার কথা এবং হয়েছেও তাই না হলে সিস্টেম ধসে যেত
আমি জানলাম, বুঝলাম, সবে আজ এই কালো মেঘ, এই চাঁদ...’
এমনসময় ঘরের এক কোণে মেঘে বজ্রপাত হলো বৃদ্ধ তাকাল সেদিকে  দেখতে পেল মেঘের ছোট্ট স্তূপটা চাঁদের সামনে এসে স্থির হয়ে আছে, যেন চাঁদটাকে আড়াল করে দিতে চায়
ওদিকে মেঘের পেছনে থেকে ক্ষিপ্ত আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ এতো আলো এর আগে কোনো চাঁদকে কখনো বিকিরিত করতে সে দেখেনি
ঘরটা একইসঙ্গে চাঁদের আলোয় আর বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে
প্রকৃতি চক্রধর্মী! তার ধর্মকে মেনে নিয়েই তার সঙ্গে সম্পর্ক কর
হঠাৎ পেছনে কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল বৃদ্ধ মেয়েটা চোখ খুলেছে
তোমার ধ্যান ফুরোল?’
প্রকৃতি চক্রধর্মী, তাই পুনরাবৃত্তি সত্য চাকা যখন সচল তখন স্থানাঙ্ক বদলায়, এবং এটাই প্রাকৃত, তাই নতুনত্ব এতো কাম্য মানুষের নতুনত্ব এতো কামনার বস্তু সমস্ত প্রাণির তারা পরস্পরের ওপর প্রভাব খাটায় নতুনত্ব আমাদের প্রভাবক এবং আমরা প্রাণিরা, নতুনত্বের প্রভাবক
আচ্ছা, বড়, বলো তো চাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস কাদের বেশি?’
বৃদ্ধ বলল, ‘আমি জানি না’ ‘শিশুদের কালের সংখ্যারেখা ধরে বিয়োগচিহ্নের দিকে হাঁটলেই শিশু হওয়া যায় আমি তোমাকে সংখ্যারেখাটা এঁকে দিচ্ছি তুমি শিশু হয়ে যাও আবার শুরু করো করবে?’
তরুণী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল
বৃষ্টির তোড় বাড়ল ঘরের ভেতর চাঁদের আলোর ঢেউ আরো বড় হলো
বৃদ্ধ বলল, ‘বেশ শিশু হলে তো একটা আমার নতুন জীবন পাই শুধরে নেবো সব সম্ভব তো?’
সম্ভব
বৃদ্ধ শান্ত মুখে মেয়েটার এঁকে দেওয়া সংখ্যারেখার ওপর পা রাখল
জানালার জনশূন্য বাহিরটা বদলে যেতে থাকল এসময় কেউ কি দৌড়ে গেল হঠাৎ? একটা যেন কালো ছায়া; নাকি চোখের ভুল
নিজেকে ভীষণ নেশারু লাগছে বৃদ্ধের তার পায়ের পাতা বদলে যাচ্ছে
বদলে যাওয়া দেহে হঠাৎ মাথার ভারে আর পায়ের অনভ্যাসে টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই তরুণী তাকে জাপটে ধরে ফেলল
ছাড়ো আমি একাই খুব পারি
শিশুর কণ্ঠে আত্মাভিমান
সশব্দে দরজা খুলে গেল এসময়
সবার চোখের আড়াল হয়ে খোলা দরজা দিয়ে তখন বাইরে বেরিয়ে গেল চাঁদ আর মেঘ
ঘরে প্রবেশ করল একদল মানুষ
প্রত্যেকের পোশাক এক; পুরোপুরি সাদা, কেবল সেলাই পড়ার জায়গাগুলোয় কালো পুলিশের পোশাক ওদের কণ্ঠ উচ্চকিত, পেশি স্ফীত, অস্ত্র উদ্যত
তুমি একা কেন বাকিরা কোথায়?’
আমি একাই ছিলাম
মোটেই না সবকটাকে আমাদের চাই সব শুনেছি আমরা
আড়ি পেতেছিলে?’
যা পেতেছি তাকে আড়ি বলে না, বলে ফাঁদ বল কোথায় লুকিয়েছে নয়তো এদের লেলিয়ে দেবো
মেয়েটা দেখতে পেল পেছন পেছন আরো কিছু তরুণ-তরুণী ঘরে এসে ঢুকেছে এদের পোশাক পুলিশের উল্টো প্রত্যেকের দেহে কালো পোশাক কিন্তু সেলাইয়ের অংশটুকু সাদা ওদের কাপড়ে ঢাকা মুখ দেখার উপায় নেই
ওদের দেখিয়ে পুলিশের পোশাকধারীদের একজন বলল, ‘ওরা যা করবে- তা কিন্তু আমাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর! ভালোয় ভালোয় বলে ফেলো বুড়োটা কোথায়, বাচ্চাটাই বা কোথায়!’
ওরা সবাই আমার ভেতরে
তুই যে ডাইনি তা কি আজকের কথা?’ হিসহিসিয়ে বলল আরেকজন
তোমাদের শরীরেও ওরা আছে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসবে ওরা বের করে আনো
হড়বড় করে বলল মেয়েটা
প্রশ্ন করে বের আনবো!’ বিস্মিত পুলিশের একজন
আবার বল তো! আরেকবার বল কী বললি! প্রশ্ন করে বের করে আনব?’
কণ্ঠগুলো সমস্বরে ঘর ফাটিয়ে হাসতে থাকল
হঠাৎ প্রথমবার কথা বলে ওঠা পুলিশ লোকটা তাকাল অপর ওই দলের দিকে চোখে স্পষ্ট ইশারা যেন বলল, যাও, পথ পরিষ্কার তোমাদের!
অপর দল থেকে একজন হাত তুললআর আপনারা?’
আমরা?’ বলল পুলিশ সদস্যটিআমরা তো মৃত্যু নিশ্চিত করব! তোমরা আগাও ভয় নাই আনন্দের সাথে আগাও!’
উপর্যুপরি আঘাতের প্রত্যেকটা তরুণীর খুলি কেটে বসে গেল, বুকের গভীরে পৌঁছাল খুলিতে বসানো অস্ত্র ফিরে এলো, বুকেরটা আর ফিরল না আটকে গেছে পর্শুকার খাঁচায়
কেউ একজন শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘থাক
পুলিশদের ভেতর থেকে একজন এসে বাঁ হাতের কব্জির ওপর তার ডান হাত রাখল, তারপর পিস্তলের ঘোড়া চাপল তিনবার
পরমুহূর্তে বাহিরটা একবার বজ্রের ভয়ানক ঝিলিকে ঝিকিয়ে উঠল, আর সেই ঝিলিকটা টুকে নিয়ে তার আয়নায় আটকে ফেলল চাঁদ
ঠিক তখন দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজার কবাট বন্ধ হয়ে গেল বাহির থেকে ছিটকিনি তুলে দিলো কেউ কারা যেন ঢিল ছুড়ল জানালায় চুরচুর করে ভেঙে পড়ল কাচ
বাড়ির চারপাশটা যেন বহু লোকে ঘিরে ফেলেছে ওরা কথা বলছে নিজেদের ভেতর বন্ধ দরজার নিচ আর ভাঙা জানালা দিয়ে সেই মিলিত স্বর একটা দানবীয় মন্ত্রপাঠের মতো ঘরে আসছে
ঘরের ভেতর, প্রত্যেকে, পরস্পরের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল মুহূর্তে কেমন বিভ্রান্ত আর ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে সবাই  

No comments:

Post a Comment