Total Pageviews

হামীম কামরুল হক এর সাক্ষাৎকার ও গল্প


হামীম কামরুল হক
সাক্ষাৎকার

আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
গল্পের শিল্প হলো বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে গল্পটিকে নিয়ে আসা
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
ভাষা নির্মাণ বিষয় যেকোনো কিছু হতে পারে ভাষা নির্মাণই কোনো কিছুকে গল্প করে তোলে ফলে দুয়ে বিশেষ প্রাধান্য দিই তবে বিষয় অনন্য হলে তো ষোলআনা পূর্ণ কমলকুমারের কেবল ভাষা নির্মাণ অনবদ্য নয়, বিষয়গুলিও অনবদ্য
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি একেবারে ঠিক করে রেখেছিলাম যে, একটি জাদুবাস্তববাদী গল্প লিখব সেটা হলো কতটা হলো কে জানে, তবে এটাই আমি করতে চেয়েছিলাম
নিরীক্ষা আসলে যেমন কমা দিয়ে দিয়ে লিখেছি কোনো জায়গায় দাড়ি দাবি ছিল, কিন্তু সেটা মানিনি এই যে মানলাম না, সেটা একটু ঝুঁকির সেই সামান্য ঝুঁকিটাই নিতে চেয়েছি একে নিরীক্ষা বলা যায় কি? মোট কথা প্রচলের বাইরে থাকতে চেয়েছি ইচ্ছা করে দৈনিক পত্রিকায় গল্প দিলে তারা কি এটা ছাপতে পারত? প্রশ্নটাও উঁকি দিয়ে গেছে
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফর্ম স্টাইলই যদি না থাকলো তাহলে আর এখন গল্প লেখা কেন? এখন তো নারায়ণ গাঙ্গুলি কি সুনীল গাঙ্গুলিদের মতো গল্প লেখার দিন নয় ফলে নতুন কিছু করা দরকার বিষয়ে, আঙ্গিকে, স্টাইলে, আরো যত দিক আছে তা অত্যন্ত দরকারি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি
বাংলা গল্পে নিয়ে কি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে? হলে কিভাবে হয়েছে
বাংলা গল্পে অনেক নিরীক্ষাই হয়েছে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হাংরি, নিমসাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী বাংলাদেশে ষাট আশির দশকে নানান নিরীক্ষা চোখে পড়ে নব্বইয়ে সব মিশে গেছে যদিও দশক ভেদে এসব বলার মুশকিলও আছে
ভাষা, চরিত্র, বর্ণনা কত দিকে নিরীক্ষা হয়েছে আমি যেমন একটা গল্প লিখেছিলাম একটাও আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার না করে ভয়াবহ আপত্তিকর একটি গল্প লিখব সেটা পড়ে অনেকেই তাই বলেছিলেন, যে সেটা সম্ভব করেছিলাম আমাদের গুরুরা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, তারপর তিন বাড়ুজ্জে, সতীনাথ, সমরেশ বসু, পঞ্চাশ  দশকের পশ্চিমবঙ্গে এক ঝাঁক লেখক, দেবেশ-সন্দীপন-শ্যামলরা তো মাতিয়ে দিয়েছেন কমলকুমার অমিয়ভূষণ তো আর কী বলব, নিত্য তাজা রেখেছেন বাংলা গল্পের পথ অল্প কথায় বলা যাবে না মিনি সাক্ষাৎকারে আর কী বলব?
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
না বিকাশ থেমে যায়নি একটু ধীর হয়েছে লেখালেখি একটা নৈতিক কাজ তবে সুনীতি প্রচার বা ধর্মপ্রচারে মতো নীতির কাজ নয় এটা ভালো মতো বোঝা দরকার এটা নাস্তিক্য-আস্তিক্য বা দেশ উদ্ধারের জায়গাও না সবার আগে এটা শিল্প হলো কিনা, তারপর বাদ বাকি বিচার---আপাতত এটুকুই বলি ধন্যবাদ

বাস্তবের গলনাঙ্ক

পাঁচ টাকার কয়েনটা ঠিকমতো পকেটে রেখেছি তো, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকটি তার জিন্সের প্যান্টের পেছন থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেখবে, এবং সেটা সে দেখতে যাচ্ছিল এমন একটা জায়গায়, যেখানে একটা বাড়ির পেছন দিয়ে পায়ে চলার পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে, এখনকার কমিশনারের তৎপরতায় এই পথ এখন হাল ফ্যাশানের ইটের তৈরি, এগুলোকে সিরামিক ইট না টাইলসের মতো কিছু, কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না, যারা দিনের পর দিন এই পথ দিয়ে যাচ্ছে আসছে, তারাও জানে না, যদিও এই পথটা গেছে বস্তির দিকে এবং একটু জঙ্গলমতো আছে বলে, দিনের একটা সময় এটা নির্জন হয়ে যায়, সারাদিনেও তেমন কেউ পথে যায়-আসে না, তবে পথে শর্টকাট মারা যায় বলে কেউ কেউ সুযোগ বুঝে পথে আসে, আর আসে বস্তিতে নিষিদ্ধকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা বা নারীপুরুষ, নিষিদ্ধ মানে মাদক আর সুরত-সওদার কাজে, অবশ্য এই বাড়ির এই কোণটা আরো বেশি নির্জন হয়ে গেছে প্রায় সপ্তাহ খানিকের জন্য, ঈদের ছুটির আগে-পরে দিকটাতে লোক প্রায় আসে না, আর সেজন্যই ঘটনার সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল, কয়েনটা তার দিন আগে শাহ্বাগের ফুটপাতের দোকান থেকে কেনা মানিব্যাগের ভেতরে আরো একটা ছোট্ট ব্যাগ, চেইন লাগানো, তাতে রাখা ছিল, কিন্তু চেইনটা লাগানো হয়নি, তাই সেটা দেখতে গেলে, অসাবধানবশত বা তাড়াহুড়ার জন্য কয়েনটা ওই ফুটপাতে গড়িয়ে পড়ে, আর গড়িয়ে পড়ামাত্র সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক, মুখে একটাইস্ধরনের শব্দ করে গড়াতে থাকা কয়েকটার পেছনে ছোট্ট একটা দৌড় দেয়, আর সেই দৌড় তার মাত্রামতো যেখানে পৌঁছাতে পারত, তার আগেই কয়েনটা কাত হয়ে পড়ে যায়, আর ঠিক তখন, কয়েনটা তুলতে গেলে, সে দেখতে পায়, এক অসামান্য পা, ছুঁচালো পায়ের আঙুল, চাঁদের মতো সাদা নখের প্রান্ত, আর তাতে গোলাপের পাপড়ির রঙ, পায়ের আঙুল পায়ের গোলাপি আভা দেখে ওপর দিকে তাকাতে গিয়ে, শাড়িপড়া এক মালকিনের মুখে তার দৃষ্টি গিয়ে থামে এবং সে বুঝতে পারে, এমন সুন্দর মুখ ইহজগতে সে আর দেখে নাই, সেই সঙ্গে ভেসে আসা জুঁইফুলের গন্ধটাও সে চিনতে পারে, এবং সেই যে এক হাত কয়েন তুলতে আর ঘাড় উঁচু করে ওপর দিকে তাকানোর ভঙ্গি নিয়ে সে স্থির হয়ে যায়, এর সাত দিন পর, একজন মানুষ ওই পথে ওমন করে মাটিতে বসে থাকা তাকে দেখে প্রথমে ভয় পায়, পরে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিতে তার মনে হয়েছিল লোকটা না জানি শক্ত কাঠের মতো করে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকটি সংবিৎ ফিরে পায়, এবং তার মনে হয়, মাত্র মুহূর্তখানিক সে এমন করে ছিল, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়, কোথায় গেল নারীটা, তার চেহারা চোখে লেগে আছে, কেবল জুঁইফুলের গন্ধটা নাই, কিন্তু তার মনের ভেতরে তখন ওই জগতের সবচেয়ে সুন্দর পা সবচেয়ে সুন্দর মুখ দুটো বারবার ফিরে আসতে থাকে, এই ুটো ছবিকে মনের মধ্যে বারবার ডুবিয়ে ভাসিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে, এবং দেখে তার অসুস্থ মা বিছানায় প্রায় যায়যায় অবস্থা, সাত দিন ধরে এই বুড়ি বিছানায় পড়ে আছে, কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য তার মল বের হয়নি, কিন্তু তার মুতের গন্ধে গোটা ঘর করছে, যুবক মায়ের গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিলে বুড়ি খোনা গলায় বলে ওঠে, বাবা আইলি! কই ছিলি গত সাত দিন? আমার জান তো যায় যায়, কেবল চোখের সামনে ক্যালেন্ডারের দিতে তাকাইছি, আর ভাবছি, একদিন গেল, দুদিন গেল, তিন দিন গেল, চার দিন গেল, তোরও কোনো দিশা নাই, আর পরিনাও আসে না, পরিনারে ফোন করেছি, তারেও পাই না, এর ভিত্রে বিছানা নষ্ট করছি কয়েকবার, তারপর আর হুশ নাই, তখন যুবক বলে, কও কি মাও, সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, সে নিজেও তাহলে সাত দিন খায়নি, এই সাতদিন তার মোবাইল ফোনে কোনো ফোন আসেনি, সেটা মনে হতেই সে দেখে সে বন্ধ না করলেও মোবাইল ফোন আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আছে, কীভাবে এটা ঘটল তা বুঝতে পারে না, সে বোঝা পরে বোঝা হবে, আগে মা বেটায় খেয়ে  নেওয়া দরকার, কিন্তু তার আগে বিছানার চাদর আর মায়ের গাতো ধোয়ানো দরকার, মুতের গন্ধটা এবার ঝাঁঝালোভাবে নাকে  লাগে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের ভীষণ রাগ হয়, মাকে দেখাশোনা করারজন্য রাখা পরিনাকে ডাক দেয়, পরিনাকে ফোন করে, তার ফোন বন্ধ পায়, পরিনা কই? হের তো কোনো খবর নাই, তারে কী আর কম ডাকছি, কত কইরা কইলাম, একটু খাইতে দেও, হেও তো উধাও! যুবক বলে, তাহলে কবে থেকে তুমি খাও নাই, খোনা গলায় বুড়ি উত্তর দেয়, শেষ যে পাশের বাড়ির কার দিক থেইক্যা কেক দিয়া গেল, জন্মদিন না কী ছিল, ওই ঢঙ্গি মাইয়াটার, যারে তুই নাকি সিনেমায় নামাবি, হেই দিন থেইকা, মাইয়াটা তো প্রায় দিনই আইত, তুই যে উধাও হইলি, হের পর তো অরও কোনো পাত্তা নাই, পরিনা নাই, তুই নাই, হে নাই, বুঝলাম না কিছু, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে, সেও টের পায়, তার সারা শরীর জুড়ে এক দানবীয় ক্ষুধা সাপের মতো ছোবল দিচ্ছে, পাগল হয়ে যাবে সে, সে বলে, মাও, আমি যাইতাছি, আর আইতাসি, বলেই সে দৌড়ে বের হয়, আগের সেই পথে নয়, বাড়ির সামনে দিয়ে, সে পঞ্চাশ গজখানিক সামনে এক হোটেলে যায়, ওখানে, গিয়ে
কাবুল মিয়াকে বলে, বলতে বলতে সে পকেট থেকে টাকা বের করে, মায়ের প্রিয় নানরুটি আর লটপটি দিতে বলে, কাবুল কয়, লটপটির দিন কি আইজ? গিলা-কলিজা কি একলগে পাওয়া যায়? কদিন জমলে তো তা দিয়ে লটপটি, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের তখন সময় নাই, যা আছে দেন তাড়াতাড়ি, কাবুল বলে, ডালভাজি, পরোটা আর ডিমভাজি দেওয়া যাবে, চলবে? সে বলে দৌড়াবে, চার পরোটার দুইটা ডিম আর দশটাকার ডালভাজি, কাবুল তখন তিনটা আইটেমের নাম পরিমাণ বলে হাক দেয়, চার পরোটার দুইটা ডিম আর দশটাকার ডালভাজি পার্সেল, এমনিতে পুরো জিনিস পাওয়ার পর যুবক বিল মেটায়, কিন্তু আজ আগেই মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়েছিল, ফের ওই মেয়েটার কথা আবার মনে হু হু করে জেগে ওঠে, মেয়ে না নারী, আহা কী গায়ের রঙ, কী মুখের আদল, কী রূপ, কত নায়িকাকে তো দেখল, কিন্তু এমন একজনও তো এর তুলনায় মেলে না, এক ডিরেক্টর কইছিল, আসল নায়িকারা কখনো সিনেমায় আসে না, যাদের জীবন নিয়ে সিনেমা হয়, তারা থাকে সমাজের ভেতরে মিশে, যেমন যারা গল্প উপন্যাস গরিব মানুষদের নিয়ে লেখে, তারা জানে জন গরিব মানুষ গল্প উপন্যাস পড়ছে, অবশ্য নিয়ে তর্ক হতে পারে, তর্ক করতে গেলে আমরা এই সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের অনুভূতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারব না, এই যে মানিব্যাগ বের করছে, তখন সে ফের সুগন্ধ পায়, ঠিক কাবুল মিয়ার দোকানের পাশ দিয়ে একটা মোটর সাইকেল যায়, তাতে বসে থাকা নারীটি, যে কিনা পুরুষ মানুষের মতো দুপাশে দুপা রেখে মোটর সাইকেলে বসেছে, আজ তার পরনে নীলজিন্সের প্যান্ট, আর ফতুয়া, খোঁপাটা চূড়া করে মাথার ওপরে বাঁধা, সেখান থেকেই গন্ধটা আসে,  সে মোটরসাইকেলের নম্বর পড়ার সময় পায় না, হুস করেই গলির মোড়ে উধাও হয় সেই মোটরসাইকেল, তখন ফের সে বর্তমানে আসে, ততক্ষণে পার্সেলটা হয়ে গেছে, সে পার্সেল নিয়ে এক দৌড়ে বাসায় ফিরে আসে, এসে দরজা খুলে বিছানায় চোখ যেতেই দেখে বিছানা ফাঁকা, কী ব্যাপার, মাও মাও, তখন খোনা গলায় ডাক আসে, বাবারে, আমি আওয়াজের আন্দাজ করে সে দেখে মা, কাঁথা ুপাশে ঝুলে আছে, আর মা ভাসছে একেবারে ছাদের গা ঘেঁষে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের চোখ তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, মা মা, সে আর্তনাদ করে ওঠে, তার হাত থেকে পার্সেলটা পড়ে যেত আরেকটু হলে, সে হঠাৎ মনে করে মাকে জ্বিনে আছর করেছে কিনা, সে সঙ্গে আরো সতর্ক হয়ে ওঠে, কোনোভাবেই ভয় পাওয়া যাবে না, এমন একটা জিদও তার তৈরি হতে থাকে, মা ছাড়া এই দুনিয়ার তার কেউ নাই, কত মেয়ের সঙ্গে সে কত কিছু করছে, কিন্তু বিয়ে করতে ভয় পায়, কেবল মনে হয়, মাকে যদি বৌ কষ্ট দেয়, তো সেই বৌকে সে খুনই করে ফেলবে, মায়ের প্রতি এই ভক্তি তার কেন হলো, সে জানে না, মা তাকে কতটা ভালোবাসে তাও জানে না, মা তো ভালোবাসে তার একমাত্র মেয়ে জরিনাকে, জরিনার স্বামীর একটা রিক্সাগ্যারেজ আছে, জরিনা সুন্দর যতটা ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল চটকদার, মহল্লায় সবচেয়ে সেক্সি মেয়ে বলে তাকে পোলাপানের মনে হতো, জরিনা বরং নায়িকা হতে গিয়ে পারেনি, কিন্তু সে তার ভাইকে সিনেমার জগতে রেখে চলে এসেছে, জরিনা এখন থাকে শনির আখড়া, সেখানে তার স্বামীর পাঁচতলা বাড়ি, বিয়ে হয়েছে ছয় বছরও না, কিন্তু এর ভেতরে তিনটা ছেলে-মেয়ের মা হয়ে গেছে, বয়সকালে মাইয়া মানুষের গর্ভ খালি রাখতে নাই, এই ছবক তার স্বামী মোখলেস কোথায় পেয়েছিল, কে জানে, তবে মোখলেস সাটাতে পারে, সাটাতে পারে যেমন লালপানি, তেমন বৌকে, যেদিন ধরে, সারারাতে ছাড়ে না, ফলে জরিনাও আহ্লাদে ডগমগ হয়ে তাকে সঙ্গ দেয়, কিন্তু মোখলেসের সব কিছু যেন ভাগভাগ করা, এক কাজে আরেক কাজ ঢুকে পড়ে না, একটা ধরে তো সেটা নিয়েই থাকে, কাজগুলিরে বগি বগি কইরা ভাগ কইরা লইছি, বুঝলানি, টেরেনের কমপার্টমেন্টের মতো, জীবন হচ্ছে টেরেন, আর কাজ হচ্ছে বগি বগি ভাগ করা, এজন্য সপ্তাহে টানা দুদিন সে ছেলেমেয়ের বৌয়ের জন্য রাখে, জরি, তোর সারা সপ্তার খোরাকি , বলে জরিকে যেমন সেটা হাতে ভরে টাকা দেয়, যখন সে জরির শরীরে ভর করে, জরির শরীরটাও সে ভরিয়ে দেয়, তেমনই দিয়েছে গা ভরে গয়না, আর দিনরাত তো টিভি চলছে, সিনেমা চলছে, জরি আর বাংলা ছবিই দেখে না, দেখলেই তার মন খারাপ হয়, এমন পপি, শাবনূর, অপুতো সে নিজেই হতে পারত, কী কম আছিল তার, হিন্দি দেখতে দেখতে নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে হিন্দি বলে, মেরে পাস বাপ, ছেলে উত্তর দেয়, নেহি আউঙ্গা, তুম কিউ মুঝছে পুচতা থা, ভুলভাল ঠিকশুদ্ধ চলতে থাকে মা-ছেলের আলাপ, মাঝে মাঝে সিনেমায় টুকটাক কাজ করা ভাইটা এসে,  বোন ভাগ্নের বাতচিতে ব্যাপক বিনোদন পেয়ে যায়, জরির সারাদিন মুখ চলতে থাকে, কী জরি কী হয়ে গেছে, আগের সেই একমুঠি কোমর আর তার নিচে বিশাল ঘড়ার মতো পেছনটা এখন মিলে গেছে, বিশাল আকৃতির কোলবালিশের ধড়ের ওপরে জরির ছোট্ট সুন্দর মাথাটা, তবে দীঘলচুল আছে জরির, জরির মতো সুন্দর না হলেও তাদের প্রোডাকশনে হীরামনকে বড়ই মনে ধরে আছে যুবকের, প্রথম দিকে নায়িকা করবে বলে, ভালোমতো কায়দা করেছিল বেশ কয়েকদিন, হীরামনের কোমরটা দুহাতের দুপাশ দিয়ে ধরলে তর্জনি আর বুড়ো আঙুলে মধ্যে মাত্র কয়েক পাঁচ কি -আঙুল ব্যবধান থাকে, আর তেমন হলো তার পেছনটা, কিন্তু বুকটা বলতে গেলে প্রায় সমান, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক আগেও দেখেছে, যাদের পেছনাটা বেশ ভারি, বুক তাদের
গাওগেরামের ফসলি জমির মতো সমতল, দুটোই যাদের ভারি তারা আবার আকারে ছোটখাটো গাট্টাগুট্টা, একটাকে পেয়েছিল এমন, মেয়েটার ছিল কটা চোখ, আর গালটা গুটিবসন্ত সেরে যাওয়ার পরের দশা, খাদাখাদা মুখ, যা সুন্দর চুমু খেতে পারত, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবককে এমনিতে কারো অপছন্দ হবে না, লম্বা আর ছিপছিপে, শান্ত মায়াময় মুখ, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অভিনয়টা সে করেই উঠতে পারল না, কিন্তু সিনেমা থেকে সরেও যেতে পারল না, মনে মনে গোপন ইচ্ছা, সে একদিন নিজেই সিনেমা ডিরেক্টর হবে, কিন্তু প্রডিউসার জোগাড় হলো না, তার ডিরেক্টর বলে, ভালো গল্প পাই না, বুঝলা, সিনেমা হবে টাসকি খাওয়ার মতো, হলে ঢুকবো, মাগার আর নড়তে পারব না, এখন সেই কাহিনি যুবকের চোখের সামনে, মাকে ওমন ভাসতে দেখে, সে নিজেকে শান্ত করে, ঘরের একমাত্র টেবিলটা টেনে এসে মা যেখানে ভাসছে, সে জায়গাটায় আনে, তারপর আস্তেআস্তে টেবিলে ওঠে, টেবিলে তো মাথা নিচু করে উঠতে হয়, যে  কোনো উঁচুতে উঠতে গেলে মাথাটা মাঝে মাঝেই নিচু করতে হয়, সেও এই উঠতে গিয়ে মাথা নিচু করে যখন মাথা খাড়া করবে, তখন দেখে, মা আর ওপরে নাই, ঘরের প্রতিটি কোণে চোখ দিশেহারা হয়ে দৃষ্টি ফেলে, মাও মা, মা!, তখন আবার খোনা গলায় ডাক আসে, এইহানে বাবা, এবার সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে, সে আর বুড়ি নাই, সেই ছোটবেলায় দেখা সুন্দর মা হয়ে গেছে, যেমনটা ছিল কিশোরী জরি, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের বাপ কাঠমিস্ত্রি ছিল, ছোটবেলায় ছোট একটা ঘরে তারা থাকতো, বাপ-মা আর তারা দুই ভাইবোন, অনেক রাতে বাপ ফিরত, তারপর অন্ধকারে ভেতরে কাপড়ের খসখস, চাপা গোঙানি, দিনের পর দিন টের পেয়েছে, মরার আগে বাপ কী করে কী করে যেন এই পৌনে এককাঠা জায়গায় ুটো রুমওয়ালা একটা বাড়ি তুলে গিয়েছিল, আর আগে সামনে একই মাপে একটু ফাঁকা জায়গা মতো ছিল, সেখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনটা ছোট ছোট ঘর তুলেছে, একটা কলপাড়, একটা রান্নাঘর, একটা গোসলখানা আর একটা পায়খানা বানিয়ে দিয়েছে এই সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক, এইটুকু আছে বলে চালিয়ে নিতে পারছে জীবন, তারপরও বৌ আনতে সাহস হয় না, সুন্দর প্রাণচাঙ্গা করা, সোজা কথায় চার্মিং মাইয়া ছাড়া সে বিয়ে করবে না, অন্য দিকে সেই বৌকে তার মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, এই দুই শর্ত কোনো তালেই খাপ খায় না, একটা জিনিস আরেকটার ভেতরে ঢোকে না, যদিও জানে, সবদিকে সেরা তেমন বৌ কেউ কোনো কালে পাইনি, এমন কি চেহারায়ও, নাকটা সুন্দর তো ঠোঁটটা কেমন যেন, ঠোঁট সুন্দর তো কপালটা কেমন যেন,  চোখ নাক মুখ সব সুন্দর কিন্তু চুল নেই ততটা দীঘল বা গালে ব্রন বা মেছতা, এই রকম একটা না একটা দিকে খুঁত থেকেই যায়, খুঁতওয়ালা গরু যেমন কোরবানি দেওয়া যায় না, খুঁতওয়ালা কোনো কিছুর জন্য নিজের কোরবান হওয়া মানায় না, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবকের এই দ্বিধাদ্বন্দ¦ কাটে না বলে অস্থায়ী বা মৌসুমী কিছু সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, আর সবই টাকা বা স্বার্থের বিনিময়ে, কিন্তু কোথায় যেন একটা না পাওয়া কাজ করে, কী যেন নেই কী যেন নেইÑ এমন মনে হয়, যখন যে জায়গায় যেটা পাওয়ার কথা সেটা সে জায়গায় নেই, এই বিছানায় পড়ে থাকা মায়ের ব্যাপারটা, মা মরে গেলে তার অনেক চিন্তা থেকে তার রক্ষা হয়, কিন্তু মায়ের জন্য যে মহিলাকে রেখেছে দেখা শোনা করার জন্য, তারও কোনো খবর নেই কেন, মেয়েটাকে মোবাইল পর্যন্ত কিনে দিয়েছে, পরিনার কোনো খোঁজ নেই কেন? পরিনার কাজ হলো মাকে বিছানা থেকে তুলে পায়খানা বা বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, ঘরের কাজের মানুষের আলাদা খরচ বলে, সব কাজ যুবকই করে যায়, পরিনাকে কাজ দিয়েছে কারণ মেয়েটা খুব টিপটপ, গায়ের রঙ মাজামাজা, আর চোখনাকমুখ খুব ধারালো, কিন্তু কথায় বার্তায় বড়ই নরম, এসব কথাও তার মনে জাগে না, সে কেবল তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় বিছানায় পড়ে থাকা আর দেখতে কিশোরী হয়ে যাওয়া কিন্তু গলা দিয়ে খোনা আওয়াজ বের হওয়া মায়ের দিকে, টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো সেই রকম ভয় পাবে কিনা বুঝতে পারে না, কারণ ভয় জিনিসটা সে আসলে পায় না, তার জীবনে ভয় পাওয়ার চেয়ে বিস্ময়ই বড়, অবাক হয়ে যায় ভয় পাওয়া মতো কিছু দেখলে, ঠিক বুঝতে পারে না এই সময় কী করা দরকার, সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছে: পপির মতো পূর্ণিমার মতো নায়িকাদের, যাদের কেউ কেউ ভয়ংকর সুন্দর বলে, দেখলে গা ছমছম করে কারো কারো, এও শুনেছে, তার এসব হয় না, বড় জোর থমকে যায়, চমকে ওঠে, আজকেও সে ভয় পায় না, বলে, মা মা আমি কি ভুল দেখতাছি, তুমি কি পুরাই ঠিক আছো? মা, মা, বাপজান আয় তুই আমারে বিছানা থেইকা তোল, আমারে কিছু খাইতে দে, কিশোরী হয়ে যাওয়া মায়ের কথায় যুবক হঠাৎ বিচলিত বোধ করে, সে প্রায় লাফিরে টেবিল থেকে নামে, আর তখন, বাড়ির দরজায় হৈ  চৈ শোনা যায়, সে কিছু বোঝার আগে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সেই লোকটা, যে লোকটা তাকে ঠেলা মেরে সংবিৎ ফিরিয়ে দিয়েছিল, লোকটাকে তার ঠিক মনেও নাই, আর তার পেছন পেছন সেই মেয়েটি, যাকে দেখে সাত দিন সে মূর্তি হয়ে গিয়েছিল, এই লোকটাই তো ওই রাস্তা থেকে আপনার আংটিটা তুলছে, তুইলা পকেটে ঢুকাইছে, যুবক বলে, কীসের আংটি? কে পকেটে কী ঢুকাইছে? মেয়েটা ঘরে ঢুকেই বলে, এই কি সেই লোকটা? মেয়েটার পেছনে আরো কিছু লোক, প্রত্যেকেরই চেহারায় মারদাঙা ব্যাপার আছে, সিনেমায় ভিলেনের সঙ্গে এমন লোক থাকে, যুবক ঠিক বুঝতে পারে না, এখন যা ঘটছে তা সত্যি সত্যি ঘটছে, নাকি কোনো সিনেমার শুটিংয়ে সে আছে, কিন্তু তার তো কোনো অভিনয় করা যোগ্যতা নেই, তাই এটা সত্যি সত্যি ঘটছে, যা সত্যিই ঘটছে, তা তো সিনেমা না, সিনেমা কী আর কী সিনেমা না, সে তার নিজের মতো জানে, প্রোডাকশনে সে টুকটাক কাজ করে, ততক্ষণে লোকটা বলে যাচ্ছে, সেই একই কথা, আমি দেখলাম ওরে রাস্তা থেইকা জিনিসটা কুড়ায়া নিয়া পকেটে ঢুকাইছে, এবার মেয়েটার দিকে হা করে সে আর তাকাতে পারে না, এবারও সে ভয় পায় না, এবারও সে অবাক হয়ে যায়, মেয়েটাকে সেদিনের মতো সুন্দরও লাগে না, কেবল বলে, আমার মা সাত দিন ধইরা অসুস্থ, তার ব্যবস্থা করতে হইব, হসপিটালে লইতে হইব, তখন অন্যরা হল্লা করে বলে, কোথায় তোর মা, তোর মা ঘরের মধ্যে মটকা মাইরা পইড়া ছিল, এরপর এলাকার লোকজন তারে ধইরা নিয়া কমিউনিটি হাসপাতালে দিয়া আইছে, হালায় কি চোখের মাথা খাইছস? যুবক তখন বিছানায় দেখে, তার কিশোরী হয়ে যাওয়া মা, কি একটা রহস্যময় কারণে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, সে সবাইকে বিছানার দিকে আঙুল তুলে বলে, ওই যে আমার মা, লোকদের ভেতরে একজন বলে, হালায় পুরাই গেছে, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক তখনও মাকে ওই কিশোরী দশায় দেখছে, যাকে অন্যরা কেউ দেখতে পাচ্ছে না, এর ভেতরে হঠাৎ পরিনা ঘরে এসে, এত লোক দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়, সে সবার দিকে, আর সবাই পরিনার দিকে তাকাতে থাকে, সে কেবল বলতে পারে, যুবকের নাম ধরে ভাই যোগ করে, সে কোনো মতে একটা দুঃসংবাদ দেয়, যুবক তখন একটাই কথা এত জোরে বলে ওঠে, নাআআআআআঅ, আমি বিশ্বাস করি না! সেই চিৎকারে ঘরের ভেতরে থাকা সবার কান ফেটে রক্ত বের হয়, সবাই কাটা গাছের মতো ধুপধাপ করে ডানেবামে একে অন্যের শরীরে ওপর পড়ে যায়, আর যুবক পড়ে থাকা মানুষগুলিকে পাড়া দিয়ে ঘরের বাইরে এসে পড়ে, সে যে ওই হতবাক হয়ে সাত দিন মূর্তি হয়ে গিয়েছিল যে মেয়ের দিকে, তাকে এতটুকু খেয়াল না করে, তার বুকে পাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসে, সারা দুনিয়া তার কাছে একটা পাতালের সুড়ঙ্গ হয়ে ওঠে, কারো দিকে তাকানো কোনো কথাই আর তার বিবেচনায় থাকে না, সিনেমায় টুকটাক কাজ করা যুবক ঊর্ধ্বশ্বাসে গলিপথ দিয়ে ছুটতে থাকে

No comments:

Post a Comment