মনদীপ ঘরাই
সাক্ষাৎকার
আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
গল্পের শিল্প সত্যিকার অর্থে আপেক্ষিক। যে আলোতে দেখবেন, গল্প সে রকম আভা ছড়াবে। তবু, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গল্পের শিল্প তার জীবনবোধের সঠিক বুননেই নিহিত।
গল্পের লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
অবশ্যই জীবনকে এবং জীবনকে প্রাধান্য দেই। কারণ,
কল্পকাহিনী বলে কিছু নেই। সবই জীবনের এপিঠ, না হয় ওপিঠ।
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
এই গল্পের নিরীক্ষাটা মনের পরিবর্তন নিয়ে। সেই সাথে পরিচিত-অপরিচিতের মিশেল নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়েছে। জানি না কতটুকু পেরেছি।
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
গল্পের ফর্ম, স্টাইল আজকাল আমরা গুলিয়ে খেয়ে নিয়েছি। যার যার নিজের মতো। এ নিয়ে চুপ থাকতে চাই।
বাংলা গল্পে এ নিয়ে কি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে? হলে কিভাবে হয়েছে। বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
পরশুরাম, বনফুল থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ। গল্প নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গল্পের শুরু নিয়ে খেলেছেন সবাই সবচেয়ে বেশি। হুট করে শুরু হওয়া থেকে গোছানো শুরু। কি নেই এই বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে? এখনকার যুগটা তাড়াহুড়োর। প্রযুক্তির। তাই গল্পকারদের মধ্যেও সে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। বিকাশ থামে নি। থামার নয়। বদলেছে রং ও রূপ।
বৃষ্টিপাগল পাখি
রাত-দুপুরে ভ্রমণটা ইচ্ছে করে না রানার। চাকরিটাই এমন। রাত তিনটায় স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা ছাপা হলেই ছুটতে হয় রাজধানীতে। মালিকের বাসায়। সকালের চায়ের আগে পত্রিকার তাজা কপিটি পত্রিকার মালিকের চায়ের ট্রেতে তুলে দেয়াই তার কাজ। ওটা ছাড়া নাকি তার দিনই ঠিকভাবে শুরু হয় না।
বেতন খারাপ না। মা-বাবা আর এক বোন নিয়ে ঠিকই চলে যায়। ঝামেলা একটাই। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা। আবার ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল। একেবারে রোজ।
সারাবছর অপেক্ষায় থাকে কবে নববর্ষ, মে দিবস আর বিশেষ দিনগুলো আসবে।
ঝামেলা যেমন একটা বললাম, আক্ষেপও একটা। মালিকের সাথে আজ অবধি দেখা হয় নি। মালিক জিবরান সাহেব জানলেনও না, এই ছেলেটা রোজ কত কষ্ট করে পত্রিকাটা পৌঁছায় তার জন্য।
একদিন দেখা করতে চেয়েছিল, কিন্তু বদখত দারোয়ানটা খ্যাচ করে উঠলো,
" অই, তোর আবার দেখা কি রে! এঃ কষ্ট কইরা নাকি আসে! ক্যা রে তোরে হ্যায় বেতন দিয়া পুষে না? মাগনা করস কাম?"
আর কথা বাড়ায় নি রানা। মুর্খ লোকের সাথে তর্ক করা বৃথা। অবশ্য সে ডিগ্রী পাশ করেই বা কি হাতিঘোড়া করছে! এমন চাকরি করে মানুষকে বলতেও পারে না।
আচ্ছা তার পদের নাম টা কি?
একে একে কয়েকটা অপশন মাথায় আসলো:
নিউজপেপার এক্সিকিউটিভ,
পেপার অফিসার, নাকি ডাকপিয়ন?
শেষটা মনে আসতেই মনটা দপ করে নিভে গেল। সে আসলে তো ডাকপিয়নই!
নভেম্বর মাস। বৃষ্টি হবার কথা তো না! প্রথমে টিপটিপ আর এখন টিপটিপের বাবা অর্থাৎ ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। পলিথিনে পত্রিকাটা মুড়ে নিয়ে স্ট্যান্ডে আসলো রানা। নিজের ভেজা ঠেকাতে পারেও নি। চায় ও নি।
বাসের পেছনের লাল আলোটাকে বৃষ্টিমাখা দেখতে মন্দ লাগছে না। কেমন জানি সিঁদুরে একটা আভা। মেঘের সিঁথিতে মেখে দিলে মন্দ হতো না।
ধুর! কি ভাবছে এসব। এই কবি কবি ভাব পিয়নের মানায় না। কাউন্টারে গিয়ে টিকেট নিলো ঠিকই, বাসে উঠতে উঠতে ওটাও ভিজে চুপচুপে। পাসের সিটে হাতলে কাপড় শুকানোর মতো করে টিকেটটা শুকাতে দিলো। এরপর সিগারেট ধরাতে গিয়ে থামলো। বাসে ধরানো ঠিক হবে না।
এই তো বছর কয়েক আগেও বাসের টিকেট কাটার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতো, ইস!
পাশে যদি কোনো সুন্দরী মেয়ে বসতো...
আর এখন? খুব করে প্রার্থনা করে যাতে পাশে কেউ না বসে। আরামে একটু ঘুমিয়ে যাওয়া যাবে। সাথে আয়েশ করে পত্রিকাটাও পড়া যাবে মোবাইলের টর্চের আলোতে।
কখনকার চাওয়া যে কখন অনুমোদন হয় কে জানে? হয়ত বছর দশেক আগের করা কোন প্রার্থনা আজ অনুমোদিত হয়েছে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন এক মেয়ে এসে বললো,
" এক্সকিউজ মি, জানালার পাশের সিটটা আমার।"
এর মধ্যেই কেউ আসবে না ভেবে আয়েশ করে আধো আধো শুয়ে গেছিলো রানা। ধরফরিয়ে উঠে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বললো,
" প্লিজ"
মেয়েটা কিছু শুনলো কিনা বুঝতে পারলো না রানা। কানে ইয়ারফোন। চুপ করে যেয়ে সিটে বসলো।
দশ বছর আগে হলে ঠিকই মেয়েটার ব্যাপারে কৌতুহল দেখাতে ছাড়তো না। সময়ের ঢেউয়ে ওসব ভেসে গেছে কবে...
মোবাইলের আলোতে গরম গরম ছাপা পত্রিকাটা পড়তে শুরু করে রানা। প্রতিদিনই এক কপি বেশি করে আনে। ব্যাকআপ। পত্রিকা পড়তে পড়তে সময়ও কেটে যায় বেশ।
-এটা কি আপনার?
দুই সিটের মাঝখান রাখা হাতলের দিকে ইশারা করে রানার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল মেয়েটা।
-আরে না না। ওটা আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। প্লিজ।
-মানে ? এই টিকেটটা কি আপনার না? আমি ইউজ করব ? যড়ি ভঁহহু!
মুহূর্তেই লজ্জ্বা পেয়ে যায় রানা। একটু আগে হাতলে ভেজা টিকেটটা সেই তো শুকাতে দিয়েছিল।বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি টিকেটটা পকেটে ভরলো সে।
ততক্ষণে দুর্ঘটনা একটা হয়ে গেছে। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে রানার। কিসের দশ বছরের ইতিহাস! রানা হারিয়ে গেছে তার সহযাত্রীর স্নিগ্ধতায়। সুন্দরী শব্দটার চেয়ে স্নিগ্ধ শব্দটাই বেশি বেশি মনে আসলো তার।
শুরু হলো সবকিছু লক্ষ্য করার অপরিচিত খেলা।
লাল ড্রেস, হাতে চুড়ি, হাতব্যাগের সাথে ঝোলানো অ্যাপ্রন...
এমনকি কানের ইয়ারফোন...
ওটাতে লেখা ংশঁষষ পধহফু.
এখানেই থামে রানা। এ কেমন নাম স্কাল ক্যান্ডি? মেয়েটা ডাক্তার বলেই কি স্কাল-টালের দিকে আগ্রহ বেশি নাকি? আচ্ছা, এই ঝুম বৃষ্টিতে সে না ভিজে গাড়িতে উঠলো কিভাবে? প্রশ্নটা তাড়া করে ফেরে। উত্তর জানার উপায় নেই। কার দুঃসাহস আছে সাপের লেজে পা দেয়ার।
দ্বিতীয় দফা বৃষ্টির সাথে দেখা। হঠাৎ বৃষ্টির শব্দ আর নীরবতা ভেঙ্গে মেয়েটা বলে উঠলো,
"এক্সকিউজ মি, জালনাটা একটু টেনে দেবেন?"
রানার জানালা টানার স্পিড দেখে মনে হলো তার পেশাই বাসের জানালা টানা।
-থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমার কথায় কষ্ট পাবেন না। আসলে ওভাবে বলতে চাইনি কথাটা।
-আরে ধুর। কি বলেন। এটা কোনো ব্যাপারই না।
রানা ভেবেছিল গল্প জমবে। কিন্তু না। ততক্ষণে মেয়েটার কানে ঢুকে গেছে স্কাল ক্যান্ডি।
রানার মনের সাগরে যেন জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। সিগনালের ব্যবস্থা থাকলে নির্ঘাত ১০ হতো। কিংবা তার চাইতেও বেশি কিছু....
এসব সফরের একটা সুখকর দিক আছে। ফুল অব সারপ্রাইজেস। হঠাৎ গাড়ী বিকল। ওদিকে সূর্য আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বৃষ্টি বেড়েছে।
একটু একটু করে গাড়ীর সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা দেখা দিচ্ছে। রানারটা আরও একটু বেশি। চায়ের ট্রেতে পত্রিকা না পৌঁছালে আজ থেকে হয়তো চাকরিটাই থাকবে না। সে অটো নিয়ে চলে যেতে পারতো। বাধ সাধলো স্কাল ক্যান্ডি। না যাই হয়ে যাক, বাস থেকে সে নামবে না। আড়চোখে লক্ষ্য করলো, জানালাটা একটু ফাঁকা করে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে মেয়েটা।
দুম করে বৃষ্টির মধ্যেই থেমে থাকা বাসটা থেকে নামলো রানা। ফিরলো মিনিট পনেরো পর। চোখেমুখে বিজয়ীর ঝলক। ভিজে নেয়ে এসেছে সে। রুমাল দিয়ে মাথা মুছে পাশ ঘুরেই বললো,
-এই নিন। ইয়ারফোনটা খুলে রানার হাতে একটা আধা পানি ভর্তি বোতল দেখে বললো,
-এটা কি?
-না মানে আপনি বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছিলেন তো, তাই বৃষ্টিকে বোতলে বন্দী করে আনলাম। আপনার জন্য।
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সে বোতলটা নিল ঠিকই, তবে সিটের সামনে রাখা পকেটে রেখে দিল। একচিলতে হাসিও কি দেখেছিল রানা? ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না।
সে যাই হোক, আর দেরি করে না রানা। পত্রিকার অতিরিক্ত কপিটার ওপরই লিখতে শুরু করে দেয়। কবিতা। কিংবা মন মেলে লেখা শব্দগুচ্ছ।
লাল পোশাক, বৃষ্টি আর একরাশ অজানা আবেগ নিয়ে গড়ে তোলে ছন্দের ভাস্কর্য।
গাড়ী পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। রানা টেরই পায় নি।কখন যে গাড়ি ঠিক হলো আর কিভাবে যে পৌঁছালো কে জানে! লেখায় ডুবে ছিলো পুরোটাই। পত্রিকার ছাপার অক্ষর আর তার হাতের লেখার মিশেলে কবিতাটা খানিকটা সিক্রেট কোড টাইপের মনে হয়।
চোখের সামনে নেমে গেল মেয়েটি। হা করে অনেক ক্ষন সেদিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ নজর আটকালো তার সিটের সামনের পকেটটাতে। মেয়েটা মনে করে ঠিকই নিয়ে গেছে বৃষ্টিবন্দী বোতলটা। আহা। কি ভুলটাই সে করেছে! নামটাও শুনলো না? ঠিকানা কিংবা নাম্বারও রাখলো না! ভয়ানক মন খারাপ আর একটা চাপা ব্যথা বুকে নিয়ে ছুটে চললো জিবরান সাহেবের বাসার দিকে। বেঁচে গেছে রানা। ঠিক সময়মতো পত্রিকা পৌঁছাতে পেরেছে। তবে বৃষ্টিতে কপিটা ভিজেছে খানিকটা। ফিরতি বাসে উঠেই কবিতাটা পড়তে মন চায়। পত্রিকাটা খুলে রক্ত হিম হয়ে আসে। পত্রিকাতে কিছুই লেখা নেই। চাকরিটা আজ নির্ঘাত যাবে। ভুল করে কবিতা লেখা ব্যাকআপ কপিটা দিয়ে এসেছে মালিকের বাসায়। শুরুর চিন্তাটাই আসলো; চাকরি খুঁজতে হবে। তারপর মনে হলো, পরিবার চালাবে কিভাবে? সারাটাদিন মেঘলা আকাশের মতো মনটাও মেদুর হয়ে থাকে রানার। অন্তরে তোলপাড় হলেও কারও কাছে কিছু বলে না সে। রাতে অফিসে ঢুকে অবাক। ঢাকা থেকে মালিক ফোন করেছিল। কাল সকালে রানাকে জরুরি দেখা করতে বলেছে। রানার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই।
রাত আড়াইটা। পত্রিকার দুটো কপি নিয়ে ফের বাসে ওঠে রানা। শেষবারের মতো দায়িত্বটা পালন করে আসতে যাচ্ছে হয়তো। আজ অনেক চেয়েছে পাশে এসে বসুক কালকের সেই লাল বসনা ডাক্তার। চাইলেই কি আর সব মেলে? আজ পাশের সিটটা খালি। স্বভাবতই আধশোয়া হয়ে শেষবারের মতো পত্রিকাটা খোলে সে। মোবাইলের টর্চের আলোয়। একটা কলামে চোখ পড়তেই ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। ভুল দেখছে রানা? এ কিভাবে সম্ভব? পত্রিকাটির দ্বিতীয় পাতার নিচের দিকে ছাপা হয়েছে তার কবিতাটি। বেশ বড় ফন্ট এ। তবে লেখকের নাম দেয়া নেই। আছে পদবি। যার সংকটে সে ভুগেছে কাল অবধি। মালিকের হাতে পত্রিকা পড়ার পর কবিতাটি দেখে নিজেই ইমেইল করে পত্রিকা অফিসে পাঠায় ছাপানোর জন্য। সেই সাথে রানাকে একটা সম্মানজনক চাকরি দেয়ার জন্য তলব করে বাসায়। চাকরি থেকে বের করার জন্য নয়।
নিজের লেখা কবিতাটিই অবাক বিস্ময়ে আবার পড়তে থাকে রানা। এ যেন সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা কবির কোনো লেখা.....
বৃষ্টিপাগল পাখি
কবি: সুসংবাদ বাহক
দিলে তো সব এলোমেলো করে
পাখি আবার লাল হয়েছে কবে?
বসনে না হয় হয়নি; হয়েছিল লাজে।
এই পাখিটা বসনেতেও রাঙ্গা
ঠিকানা তার মনের জল আর ডাঙ্গা
আমি ধরতে চাওয়ার হাজার বছর আগে।
মুখ লুকিয়ে উড়াল দিলো রাগে-অনুরাগে।
ওহে বৃষ্টিপাগল পাখি....
বৃষ্টিকণার মতো করে আগলে ধরে রাখি?
পত্রিকাটা সেদিনের মতো আজও ভিজেছে। সেদিন ভিজেছিল বৃষ্টিতে। আজ ভিজছে আনন্দ আর বেদনা মেশানো চোখের জলে...
No comments:
Post a Comment