Total Pageviews

শাহীন আখতার-এর সাক্ষাৎকার ও গল্প


শাহীন আখতার
সাক্ষাৎকার

আপনার মতে গল্পের শিল্প আসলে কোনটি?
শিল্প কি বিচ্ছিন্ন কিছু? আমি যতদূর বুঝি - ছোটগল্প শিল্পের একটি মাধ্যম শেষ পর্যন্ত এটি শিল্প হয়ে উঠল কি উঠল না- সে ভিন্ন কথা এর বিচারই বা কে করবে শিল্পের সংজ্ঞাও তো সব যুগে এক নয় তাইশিল্পরচনা করছি - এমন কিছু মাথায় নিয়ে গল্প লিখতে না বসাই ভালো
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন এবং কেন?
গল্পের ক্ষেত্রে আমি প্রাধান্য দেই বা দিতে চাই -  নিজের ইচ্ছাকে, অন্তর্গত তাড়নাকে সে ইচ্ছা বা তাড়নাটি আসতে পারে ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা থেকে, বর্তমান সময়ের বা অতীতের কোনো ঘটনা বা চরিত্র থেকে একেক সময় একেকটা বিষয় প্রাধান্য পায় এখন একজন ব্যক্তিমানুষের সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়ার চেয়ে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠী নিয়ে লেখার তাড়না বোধ করি বেশি সময়টাই মনে হয় এমন যুদ্ধ, সংঘাত, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা এসবই তো ঘটছে চারদিকে আরেকটা বিষয় এখন গল্পের কেন্দ্রস্থলে উঠে আসতে চায় মৃত্যু হঠাৎ করে কাছের মানুষরা চলে যাচ্ছে বলেই হয়তো  মৃত্যুটা শুধু দেহ ছেড়ে আত্মার চলে যাওয়া বা এর বিনাশই নয়, আমার ভাবনায় আসে অনেকগুলো মন, যা স্বজনহারানোর প্রাণান্তকর কষ্ট ভোগ করে, শোকার্ত হয়
এই গল্পে আপনি কি ধরনের নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন এবং কিভাবে?
গল্পটা কীভাবে বলব, সেই তাড়না থেকেই গল্পের ফর্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এটা আলাদা কিছু নয়অলৌকিক ছড়ি২০১৮ তে লেখা গল্প হলেও ভাবনাটা আসে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তখন ভরবর্ষায় নাফ পেরিয়ে রোহিঙ্গারা টেকনাফ, কক্সবাজারে আশ্রয় নিচ্ছিল তাদের আগমনের দৃশ্যটা টেলিভিশন বা খবরের কাগজের স্থিরচিত্রে দেখে মনে হচ্ছিল, এটি বাস্তব দুনিয়ার নয় যেন বাইবেলের Exodus.
নৌকা থেকে নেমে গলাপানি ভেঙে মৌসুমী বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওরা আসছিল নৌকাডুবিতে ভেসে যাচ্ছিল তাদের নারী-শিশু, যুবক- বৃদ্ধ তখন এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক রিপোর্ট লেখা হচ্ছিল টেকনাফ বাজারের খাবারের দোকানগুলোর সামনে ওরা ঘুরঘুর করছে তখনই গল্পের ছকটা পরিষ্কারভাবে সামনে চলে আসে আব্রাহামীয় সেমেটিক তিনটি ধর্মেই যে কাহিনি আছে, এমন একটা অতিপরিচিত ধর্মীয় মিথ হবেঅলৌকিক ছড়িগল্পের অবলম্বন যা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে গল্পটাকে আলাদা করে ফেলবেঅলৌকিক ছড়িগল্পের ফর্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমার এটুকুই বলার আছে
গল্পের ফর্ম এবং স্টাইলকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বাংলা গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো খামতি আছে বলে আমার মনে হয় না সে কমলকুমার মজুমদার থেকে সুবিমল মিশ্র, সেলিম মোরশেদ তাঁদের আগে-পরে আরো খানেক লেখক তো আছেনই, যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টিকে বিশেষভাবে আমলে নিয়ে লিখেছেন, লিখে যাচ্ছেন
বাংলা গল্পের বিকাশ একটি পর্যায়ে এসে থেমে গেছে বলে মনে করেন কি? হলে কেন?
বাংলা গল্পের বিকাশ থেমে গেছে বলে মনে হয় না লেখালেখি তো চলছে অবশ্য পাঠকের আকালের যুগে লেখকেরা যে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন- সে বড় আশ্চর্য ঘটনা 

অলৌকিক ছড়ি

ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন... তুমি আপন যষ্টি তুলিয়া সমুদ্রের উপরে হস্ত বিস্তার কর, সমদ্রকে দুই ভাগ কর; তাহাতে ¯্রায়েল-সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিবে -বাইবেল

যে সনে হুকুমত কন্যাশিশুদের বাঁচিয়ে রেখে পুত্রসন্তানকে খুন করছিল, সে বছর মুসার জন্ম তার নাম রেখেছিলেন দাদি বিসমিল্লাহজান উপলক্ষে উৎসব-অনুষ্ঠান কিছুই হয় নাই, আঁতুড়তোলার মামুলি খরচাপাতিও নয় তবে শিশুর দুনিয়ায় আসার কাফফারাস্বরূপ কাছের পুলিশ ফাঁড়িতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়েছিল এভাবেই কথাটা বলতেন দাদি বিসমিল্লাহজান, লোকেজন্ম নিবন্ধনবলে গালভরা বুলি আওড়ালেও, সেই দাদিকে ছাড়াই গতরাতে নাফ নদীর এপারে উঠেছে মুসা তখন জানত না যে, দাদি নৌকায় নাই ছয় হাজার কিয়েত দিয়ে দুজনের ভাড়া মিটিয়েছিল তারপর তো ভয়ানক হুলুস্থুল- কার আগে কে যাবে ঘুটঘুটে আন্ধার রাত
দরিয়ার ধু-ধু পানির দিকে তাকিয়ে মুসার চোখ ফেটে নোনাজলের ধারা নামে দাদির থামির সঙ্গে তার লুঙ্গিটা যদি গিঁট-বাঁধা থাকত, সে কোনোভাবে ভেসে যেতে দিত না দাদিকে খোদা না করুক, ভেসে যাবে কেন বুড়ি! হয়তো তরীতেই ওঠে নাই নাতির হিজরতের সুরাহা করে পেছন থেকে সরে পড়েছে
শুরু থেকে তাই তো চেয়েছেন বিসমিল্লাহজান বংশের একমাত্র বাতি মুসা- দমে দমে বলতেন সে কথা দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সে বেঁচে থাকলে রক্তের ধারাটা তো বইবে তাই তো হাড় জিরজিরে বৃদ্ধ শরীরটা টেনে টেনে পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙেছেন, জঙ্গল অতিক্রম করেছেন দীর্ঘ যাত্রায় কখনো এনামেলের ভাতের হাঁড়িটা হাতছাড়া করেন নাই পথে পথে শাকপাতা যা- হোক সিদ্ধ করে খেতে দিয়েছেন মুসাকে
তখন এদিকে মন ছিল না মুসার ওর নজর ছিল পথের ধারের পাহাড়ের দিকে, যদি আল্লাহর নূর দেখতে পাওয়া যায়, যে নূরে পাহাড় জ্বলে, মুসা জ্বলে না কিন্তু এসব পাহাড়ের কোনোটির নাম তুর ছিল না তবে পথে সে একটি লাঠি কুড়িয়ে পেয়েছিল যার আগায় ঝুলিয়ে নিয়েছিল কাপড়ের পুঁটলি আর এনামেলের ভাতের হাঁড়িটা
মুসাদের কাফেলা যখন নাফের তীরের বালুর চরে পৌঁছায়, তখন বালিতে বোঝা নামিয়ে লাঠিটা ভারমুক্ত করে সে বালুর চর তখন কারবালা পানির কষ্ট, খানার কষ্ট নদী আর সাগরের মোহনার নোনা পানি খেয়ে বমি, কান্না, হেঁচড়-পেঁচড় তার মধ্যে এক নারী বাচ্চা বিয়োলে নবজাতকের কানের কাছে আজান দিতে ডাক পড়ে মক্তবের তালেব আলেম মুসার দু-দিন, দু-রাত পারাপারের নৌকার দেখা নাই পেছন থেকে তাড়া করছে ফেরাউনের বাহিনীর মতো বর্মি সেনা তখন সবার অগোচরে মুসা একবার দরিয়ার দিকে হস্ত বিস্তার করেছিল কাজ হয় নাই তারপর রাত নামলে হাতের লাঠিটাই ছুড়ে মারে পানিতে এবারও বিফল হয় ¯্রােতের টানে অন্ধকারে ভেসে যায় সেই লাঠি তখনই উল্টা দিক থেকে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভটভট শব্দ করে থামে এপারে সেই নৌকায় বোঝাই হয়ে মুসা গতরাতে এই অচেনা মুলুকে পা দিয়েছে মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে দাদি বিসমিল্লাহ
ফের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কোথায় উঠবে, কী খাবে দাদি! পোড়া ভিটা পোড়া খেতি-কিষ্টি শোনা যায়, ভিটেবাড়ি চষে সমান করে দিয়েছে হুকুমতের লোকজন পারিবারিক কবরস্থানটা যদি আনাম থাকে, এর শিয়ালের গর্তে হয়তো ঠাঁই নেবে দাদির আড়ে-ঠারে বলা কিছু কথা, এখন ক্ষুধা আর অনিদ্রাজনিত ঝিমঝিম করা অবশ মস্তিষ্কে মুসার যত দূর স্মরণ হয়, তাঁর মতলবটা সে রকমই ছিল সেই গোরস্থানে বছর পাঁচেক আগে দাফন করা হয়েছে বিসমিল্লাহজানের একমাত্র পুত্র, মুসার বাবাকে মুসা তখন বছরের বালক সে গোরখোদকের মাটি কোপানো দেখতে দেখতে ভাবছিল, এখানে তার দাদা, দাদার বাবা-মা আরও ঊর্ধ্বতন বংশধরেরা শুয়ে আছে বাবার জীবনটা খুব কষ্টে কেটেছে মৃত্যুটা আরও কষ্টের পয়লা হুকুমতের সেনারা বুকে গুলি করে পরে গলা কাটে মগ ফুঙ্গিরা কবরে শুয়ে বাবা সেই দুঃখের কথা বলবে তাঁর আপন মানুষদের, যাঁরা অপেক্ষাকৃত শান্তিতে জীবন কাটিয়ে গেছে
মুসা চোখ মুছে বেড়িবাঁধের পাথরের ধাপে বসে এখান থেকে পানি আরও কাছাকাছি নাফ নদীর বাঁধে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ সবার নজর নদীর ওপারে রাত নামতেই নদীর বুকে জ্বলে ওঠে একটি-দুটি কেরোসিনের বাতি তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ টর্চের আলোর ঝলক তখন বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে মুসার ব্যাটারির আলোটা কি হুকুমতের সৈন্যদের?
গত রাতের ফেলে আসা সেই বালুর চরে এখনো হয়তো ত্রিপল বিছিয়ে হাজার হাজার মানুষ এপারে আসার ইন্তেজার করছে তার মধ্যে কেউ বাচ্চা বিয়োচ্ছে মারা যাচ্ছে কেউ শরীরে পোড়ার ক্ষত, গুলির জখম দাওয়াই নেই, পথ্য নেই দুনিয়ার বুকে এমন দোজখের আজাব কোন অপরাধে? দাদি কি এখনো বালুর চরের আজাবে দগ্ধ হচ্ছে?
ঘাটে ঝাঁকে ঝাঁকে নৌকা ভিড়তে মুসা বাঁধ থেকে লাফিয়ে পানিতে নামে উল্টা দিক থেকে গলা পানি ঠেলে আসা মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে তার আগে-বাড়া সম্ভব হয় না সঙ্গে বাতিও নাই যে শত শত লোকের ভিড়ে দাদির মুখটা আলাদা করে চিনে নেবে এপারে যতটুকু আলো, সেসব ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, নয়তো মুলুকের হুকুমতের লোক-বিজিবির বা কোস্টগার্ডের টর্চলাইটের তারা তীরে তোলা মোহাজিরদের প্লাস্টিকের বস্তা, রন্ধনের সামগ্রী, কলসি, নষ্ট দেয়াল ঘড়ি, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল আর কাঁথা-বালিশের স্তুপে টর্চ টিপে তল্লাশি চালাচ্ছে সে সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মুসার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায় যদি ঝড় উঠে মাঝদরিয়ায় ডুবে মরে দাদি! মুসা বুক-পানিতে থাকতেই মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে তার মধ্যে নৌকা ভিড়ছে বিরামহীন আর সাগরের ঢেউয়ের মতোই অগুনতি সঙ্গে পানির দাপাদাপি, ইঞ্জিনের কানফাটা গর্জন
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে বাঁধের কাছের এক বাড়ির গোয়ালে আশ্রয় নেয় মুসা গোয়াল না বলে একে ছাগলের খোঁয়াড়ই বলা চলে তা- বাড়ির একমাত্র কুঁড়েঘর-সংলগ্ন গোলপাতার ছাউনির চালা এটি যার তিন দিকই খোলা আর স্বল্প পরিসরের জায়গাটিতে দুটি দড়ি-বাঁধা ছাগল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে মুসাও এদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় এখন রাত কত কে জানে বাড়ির মানুষগুলি তো মনে হয় ঘুমে কাদা সে ভাবে, বৃষ্টিটা ধরে এলে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে তখন প্রচ- শব্দে বাজ পড়লে কাছের ছাগলটার গলা জড়িয়ে বসে পড়ে মুসা অনেক দিন পর চেনা সেই স্পর্শ গন্ধটাও অবিকল সে রকম একটু পর বিদ্যুৎ চমকালে সে এই প্রথম অচেনা মুলুকের কোনো প্রাণীর দিকে চকিতে তাকায় অপরিচিত কিছু মনে হয় না বরং চোখ দুটি নিজের পোষা ছাগীর মতো মায়াবী লাগে মুসা মক্তবের তালেব আলেম হলে কি হবে, আদতে তো ছিল রাখাল- এক জোড়া সোনালি রঙের মহিষ আর গোটা চারেক বাচ্চাসহ দুটি ছাগলের ছাগলগুলি যখন আগুনে পুড়ে ছটফট করে মরছিল, তখন কত-না কষ্ট পেয়েছিল
বাড়িতে হুকুমতের আগুন দেওয়ার দিন আগেভাগে মহিষ দুটির দড়ি কেটে দেওয়া হয়েছিল আর বারো বছরের মুসাকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন দাদি ভেবেছিলেন হয়তো বাড়িতে নারী-শিশু আর অবোধ কটা ছাগল, ওদের আর কী হবে কিন্তু বিসমিল্লাহজানের জানা ছিল না, হুকুমতের জুলুম দিনে দিনে বেড়ে গেছে কন্যারাও আর রেহাই পায় না ধর্ষণ জালিমরা আগেও করত, এবার লোহু ঝরাতে শুরু করেছে মুসা দুদিন পর বাড়ি ফিরে দেখে ছাই আর ভস্ম সেদিনই আরেকটু দক্ষিণে দাদির বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ওখানে কাটায় হিজরত করার আগের প্রায় টানা এক বছর
মায়ের কথা ভাবলে মুসার মনে পড়ে, তিনি বাচ্চা কোলে বাড়ির উঠানের ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন বাচ্চাটার কবুতরের মতো গোলাপি পায়ের পাতা মায়ের কোলের এক পাশ থেকে ঝুলে রয়েছে এখন কই তার মাসুম ভাইবোনেরা? আর মা? নিজের কান্নায় ঘুম ভাঙে মুসার দেখে সে ছাগলের খোঁয়াড়ে বিচালির ওপর কুঁঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে পাশে সেই ছাগল জোড়া আর কে যেন ছেঁড়া কাঁথায় তার সারা গা জড়িয়ে দিয়ে গেছে যেমনটা মা ঘন বর্ষায় বা শীতের মৌসুমে মাঝরাতে নিঃশব্দে উঠে করতেন তা সত্ত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগে খোঁয়াড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মুসা বেড়িবাঁধের দিকে সে আর ফেরে না কাদামাটির পথ ভেঙে উল্টা দিকে হাঁটতে শুরু করে
সামনের বাজারটা খোদার বিহানেই গমগমে দূরপাল্লার বাস থেকে শহরের সাহেব-সুবারা নামছে আর ব্যাগ কাঁধে ছুটছে চা-নাশতার দোকানের দিকে ভোরের বাতাসে সুখাদ্যের ঘ্রাণ তাতে মুসার চাপা-পড়া পেটের খিদেটা চাগিয়ে উঠলে সে দোকানের সামনে ঘুর ঘুর শুরু করে
একজন খাবার দোকান থেকে বেরিয়ে মুসার দিকে ক্যামেরা ধরলে পাশের দোকানের শেডে আড়াল নেয় ছবি তোলাটা ভড়ং, আসলে পাচারকারী- ভাবে মুসা আর ভেতরে-ভেতরে ফুঁসতে থাকে সাপের মতো সেই লোক ফের দোকানে ঢুকে খাবারের প্লেট হাতে বেরিয়ে কাছে ডাকলে মুসা পা ঘসটাতে ঘসটাতে এগিয়ে যায় হামলে পড়ে খাবারের ওপর অবস্থায় ক্যামেরায় কয়বার ক্লিক ক্লিক শব্দ তুলল, কতবার তার বুভুক্ষু চেহারার ফটো খিঁচলো, সে তা থোড়াই পরোয়া করে খাবার শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে মুসা ভাবে, ছবি তুলতে দেওয়ার বিনিময়ে যদি দু-বেলা অন্ন জোটে তাই সই বাস্তবিক সে এখন ইন্তেজার করছে এমন একটা ছড়ির, যা নিমেষে সর্পে পরিণত হবে
জীবনের নিশানা মিলে যেতে খোলা মনে চারপাশে নজর বুলায় মুসা জায়গাটা টাউনশিপ না হলেও জমজমাট একটি বাজারই বটে পাকা দোকানপাট আছে কিছু কাছাকাছি একটা স্কুলঘর, যার ঢালা বারান্দায় কাদামাখা মানুষ গাদাগাদি করে ঘুমাচ্ছে মাঝে স্তুপ করে রাখা জঞ্জালসম সংসারের ছেঁড়া-খোঁড়া ময়লা সামগ্রী এমন একটি ছিন্নমূল দলের প্লাস্টিকের বস্তার আড়াল থেকে যে উঠে আসে, তাকে দেখে মুসা দু-কদম পিছিয়ে যায় ছেলেটা কি তার যমজ ভাই, না আয়নায় সে নিজেকে দেখছে? ফারাক শুধু ওর গালে সেনেকারের মতো সাদা বেলেমাটির ছোপ আর পরনে হাঁটু-কাটা আকাশি জিন্স এমন আরও কিছু বৈসাদৃশ্য নিয়ে ওরা যমজের মতো দোকানের সানশেডের নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে কারওরই যেন কথা কওয়ার বিন্দুমাত্র শক্তি বা ইচ্ছা নাই
সেই ক্যামেরাম্যান স্থানীয় একজনকে বগলদাবা করে এগিয়ে এলে মুসা চট করে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় এত আদেখলাপনা কেন লোকটার! ওর হাভাতে ভিখারিমার্কা গোছা গোছা ছবি তুলেও আশ মেটে নাই? কিন্তু ক্যামেরার ক্লিক নয় লোকটার কথা কানে যেতে মুসা বোঝে যে, এবার ইন্টারভিউ হচ্ছে শুরুতে পাশের বালকও খামোশ হয়তো বোবা, কালা পরক্ষণে তোতলাতে শুরু করে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে মুসার আখেরি জমানায় কি সবকিছুই উল্টোপাল্টা? মুসার জিহ্বা অনাড়ষ্ট আর হারুন তোতলা? যদিও তার কওমের বালকের নাম হারুন কিনা সে জানে না
এত হত্যা-ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওক্যামেরাম্যানের কথা রোহিঙ্গা ভাষায় তর্জমা করে স্থানীয় লোকটা শুধায়, ‘এসব নিজের চোখে সে দেখেছে কি না?’
সওয়ালের জবাব কী? আর কীভাবে তা বলা যায়? পাশের বালক কি সাধ করে তোতলায়? মনে মনে খুব তোলপাড় হয় মুসার সে যমজ ভাইয়ের মতো দেখতে বালকটির উদ্ধারে দেয়ালের ওপর থেকে মুখ সরায় দাদির হাত ধরে ছুটছিল- রোহিঙ্গা ভাষায় গড়গড়িয়ে বলতে থাকে মুসা পেছনে কালো ধোঁয়া আর আগুন, সঙ্গে চিৎকার আর গুলির শব্দ রাস্তাজুড়ে লাশ আর লাশ গুলিবিদ্ধ গলাকাটা তারপর সাগরের গর্জন সাগরটা আর্তনাদ করে দু-ভাগ হয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু তার হাতের লাঠির সে ক্ষমতা ছিল না
লোক দুটি ফেরাউনের মতোই মুসার কথাটা অবিশ্বাস করে কিন্তু যমজ ভাইয়ের মতো বালকটি খুশি হয় যদিও তার নাম হারুন নয়, শাহ আলম
স্কুলঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শাহ আলম বলে, গতরাতে ওরা ভেলায় চড়ে এপারে এসেছে এসেছে মংডুর ফাতংজা গ্রাম থেকে শাহ আলমের বাবা নিখোঁজ, বড়ভাই খুন হয়ে গেছে মায়ের সঙ্গে আছে বাদবাকি তিন ভাইবোন
মুসারে নিয়ে তোরা চারজন,’ বারান্দার মেঝেতে বসে প্লাস্টিকের মাদুর রোল করতে করতে শাহ আলমকে বলে তার মা খানিকপর ট্রাক আসবে চালান হবে ওরা কাছাকাছি কোনো রিফুইজি ক্যাম্পে মুসার কেমন হাঁসফাঁস লাগে বাতাসটা পানিভর্তি মশকের মতো ভেজা আর ভারী আশপাশের লোকগুলিও যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটে তাদের নিদ্রাহীন, ক্লান্ত চোখে ফাঁকা শূন্য দৃষ্টি নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দ নাই কারও চোখে-মুখে মুসারও কি চোখে-মুখে আনন্দ আছে? ক্যাম্পের পোকামাকড়ের জীবন সে কিছুতেই চায় না
বাজারে ট্রাকের বহর থামতে মুসা প্রাণপণে উল্টা দিকে ছুট লাগায় তাকে রে রে করে তেড়ে ধরে আনে মুলুকের হুকুমতের লোকজন শাহ আলম ট্রাকে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষছিল পাশে দাঁড়ানো ওর মা এমন সুরে বিলাপ জুড়ে দিয়েছিল যে, যেন তার পেটের বাচ্চা দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে গরুর পালের মতো খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে রাগে গরগর করে মুসা মুলুকের হুকুমতের লোকজনের চেয়ে শাহ আলমের মায়ের ওপর ওর রাগ হয় বেশি মুসা পাতানো মা চায় না, ভাই চায় না, চায় একটা ছড়ি- যা নিমেষে সর্পে পরিণত হবে
কেতাবের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে না রে মুসাসেই রাতে বিসমিল্লাহজানকে স্বপ্নে দেখে মুসা দাদি যেন বলছে, ‘ মিলাতে যাওয়াটাই পুরাদস্তুর বোকামি তুই আমার আশা ছেড়ে দে ভাই তোর সারা জীবন সামনে, তুই একাই এগিয়ে যা
আমি কোথায় এগিয়ে যাব দাদি?’ মুসা অভিমানে কাঁদো কাঁদো হয়ে ধরা গলায় বলে, ‘আমি তো পেছনে ফিরতে চাই সেই কবরস্থানে, যার শিয়ালের গর্তে গা ঢাকা দিতে তুমি এখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছ
ঘুমের মধ্যে কে একজন গুঙিয়ে উঠলে চুপ মেরে যায় মুসা ত্রিপলের নিচে শুয়ে সে কুলকুলিয়ে ঘামতে থাকে অনেক দিন পর পেটে আজ ভাত পড়েছে, ত্রাণের চালের ভাত তা- হজম হয় নাই ঠিকমতো তবে গতকাল একদিনেই দুরন্ত সব কাজ হয়েছে পরিবারের সদস্যদের মাথা গোনা, রেশনকার্ড ত্রিপল-ঢাকা ঠাঁইয়ে রঙিন ব্যাগে করে রেশনের চাল-ডাল-চিনি-তেল এনে তুলেছে ওরা শাহ আলমের মা সংসারও গুছিয়ে ফেলেছে তখন তখন সে সংসারের মুসাও একজন, যে তাদের সঙ্গে একই ত্রিপলের নিচে শুয়ে এখন রাত গোজার করছে
সকালে সংসারের কাজ বণ্টন হয় রেশনের লাইনে দাঁড়াবে শাহ আলমের মা তার ভাইবোনেরা জঙ্গল থেকে লাকড়ি আনা আর কল চেপে কলসিতে পানি ভরার কাজ মুসা আর শাহ আলমেরদুজনে হাবিল-কাবিলের মতো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করিস না বাপ’- ওরা জঙ্গলের পথে পা বাড়ালে শাহ আলমের মা ত্রিপলের ফুঁটো দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘মুসা-হারুনের মতো ভাই ভাই হয়ে থাকিস
মুসা-হারুন নাম দুটি এক সঙ্গে উচ্চারিত হতে মুসার রক্ত আনন্দে নেচে ওঠে শাহ আলমের মাকে তখনই মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে ওর সেই ইচ্ছা দমন করে শাহ আলমের দিকে তাকিয়ে এমন বোকা-হাঁদা! লাকড়ি টোকানো ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগবে বলে তো মনে হয় না যাই হোক, জঙ্গলে যাওয়া মানে তো শুধু চুলা ধরানোর কাঠখড় কুড়ানোই নয়, শক্তপোক্ত একখানা ছড়িও জুটে যেতে পারে আরও একটি সুখবর যে, ক্যাম্পে তাকে বন্দী থাকতে হচ্ছে না
জঙ্গলে যাওয়া ছাড়াও ক্যাম্পের লোকজনের সঙ্গে মুসা কাছের টিলায় ওঠে, যখন শোনে যে, নাফের ওপারে ফের আগুন দিয়েছে বর্মি সেনা তখন ওর কওমের লোকেরা আহাজারি করে, নারীরা বিলাপ করে বুক চাপড়ায়দাদির লাই আঁর মন জ্বলের’- মুসাও তাঁদের সঙ্গে গলা মেলায় কখনো সুর করে কাঁদে, ‘দাদি ছাড়া আঁই কেনে বাইচ্চুম!’ কান্না শেষে ওর চোখ দুটিতে জ্বলে জ্বলে ওঠে আগুন
নাফে নৌকাডুবির খবর এলে নদীর পাড়ে ছুটে যায় মুসা কখনো যায় কাছাকাছি বেড়িবাঁধে পাথরের স্ল্যাবে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকে তখন তার হাতে থাকে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা গজারির লাঠি লাঠি দিয়ে পানিতে ঘাই দিতে দিতে আপনমনে বিড়বিড় করে সে
দুনিয়ার কেমন বিচার- তার কেউ থাকবে না, কিছুই থাকবে না! না বাবা-মা, ভাইবোন, না ঘর-ভিটা, জমি-জিরাত, দেশ-মাটি! সে কী দোষ করেছে? ক্যাম্পেই কেন তাকে জীবন কাটাতে হবে?
এখান থেকে বেরোনোর একটাই পথ খোলা- একদিন নদীর ধারে এক পাচারকারী মুসাকে বলে, সে সিন্দাবাদ  নাবিকের মতো ভাগ্যপরীক্ষায় সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে কাছের এক সৈকতে নৌকা বাঁধা বাবদে তার পথের মাসুলও লাগবে না
মুসা ভাগ্যের পরীক্ষা চায় না নিজ মুলুকে ফিরতে চায় তার দরকার এমন এক ছড়ি, যা নিমেষে সাপ হয়ে দুশমনকে তাড়া করবে সে দেখতে চায়, দেশময় ছড়িয়ে পড়ছে অজস্র ব্যাঙ, উকুন, পঙ্গপাল- যাদের ভয়ে বর্মি সেনা আরাকান থেকে নিষ্ক্রান্ত হবে নয়তো নদী দিয়ে পানির বদলে রক্তের ¯্রােত বইবে, যেমনি তার কওমের ওপর হুকুমতের জুলুমের দরুন পানি রক্তে পরিণত হয়েছিল
নদীতে রক্তের স্্েরাত বহানো পছন্দ হয় জেহাদির টিলার ওপর থেকে নাফের ওপারের আগুন-ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে জেহাদি মুসাকে বলে, ‘ কাজের জন্য তোমাকে অবশ্যই অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে হবে গজারির লাঠিতে কিছুতেই তা সম্ভব নয়
কে বলে শুধু গজারির লাঠি?’ জেরা করে মুসা সে এমন এক ছড়ির কথা বোঝাতে চায়, যা নিমেষে সর্পে পরিণত হয়
মুসার কথায় গোসসা হয় জেহাদির বলে, ‘ শোনো হে মুসা, এটা আখেরি জমানা গোলা-বন্দুকই এখন শেষ কথা
মুসার খুব অসহায় লাগে সে কি - সামান্য মোজেজাও দেখাতে পারে না? যেমন ছোট্ট একটা ব্যাঙ? মুসা হাতের মুঠো খোলে ব্যাঙের বদলে তার হাতের তালুতে তিরতির করে কাঁপে বাতাস
কিন্তু যে দুটি পথ পাচারকারী আর জেহাদি বাতলাচ্ছে, তার কোনোটাই পছন্দ নয় ওর তাহলে কী করবে? খুব কান্না পায় মুসার সে রাগে-দুঃখে হাতের ছড়িটা ছুড়ে ফেলে নিমেষে তা সর্পে পরিণত হয়ে টিলার ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে যায়

No comments:

Post a Comment