শ্রুতি
আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মৃণাল বসুচৌধুরীর সাথে অনলাইন আলাপঃ দুপুর মিত্র
১.
সাহিত্যে আন্দোলন কেন প্রয়োজন ?
বিশদ
আলোচনার মধ্যে না গিয়ে সাধারণভাবে বলতে পারি প্রচলিত, গতানুগতিক সাহিত্য রচনার
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভূমি তৈরির প্রয়োজনেই সম্ভবত শুরু হয় আন্দোলন। রাজনৈতিক,
সামাজিক অবক্ষয়, সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা কিম্বা সাম্যবাদের উত্থান
এবং তার বিরোধিতা, এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠছিল সাহিত্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বাজার
চলতি সাহিত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন কিছু মানুষ। এক ধরণের নৈরাশ্যবোধ থেকে
ক্রমশই অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছিলেন নতুন প্রজন্মের লেখকরা। অস্তিত্বের অস্থিরতায় তাঁরা
নিজেদের মত করে লিখতে শুরু করেন, আত্মঅন্বেষণের মধ্যদিয়েই সৃষ্টি করেন নতুন
সাহিত্য। ঘোষণা হয় জেহাদের। এভাবেই
আমরা বিদেশি সাহিত্যে দাদাইজম, সুররিয়েলিজম, কিউবিজম, সিম্বলিজম, ষ্ট্রিম অফ
কনসাসনেস এবং আরো সব আন্দোলনের কথা শুনেছি। পণ্ডিত মানুষেরা সে সব নিয়ে ভালো বলতে
পারবেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন কিছু সৃষ্টির তাড়না, প্রেরণা দিয়েছে তাদের...।
২.
আন্দোলন বা মেনিফেস্টো কি সৃষ্টিশীল কিছু দিতে পারে ?
মেনিফেস্টো
বা ইস্তাহারের মাধ্যমে আন্দোলনের রূপরেখা এবং উদ্দেশ্য জানানো হয়ে থাকে। সব
আন্দোলনের সেটাই প্রথা। কোন আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিশীল কিছু দিতে পারে কিনা সে
বিষয়ে এটুকুই বলতে পারি “পথের সন্ধান দেয় কেউ কেউ, তাকে রাজপথ বানায় কেউ
কেউ।” যে কোন আন্দোলনই সন্ধান দেয় নতুন পথের, নতুন
ভাবনার। সেই সব ভাবনা থেকেই হয়ত লেখকের অন্তর্জগতে শুরু হয় অজানা কোন সৃষ্টির
উল্লাস, এবং...
৩.
শ্রুতি আন্দোলন সাহিত্যে কি প্রভাব এনেছিল ?
‘শ্রুতি’ আন্দোলন এখন ইতিহাস। বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থে, শ্রুতির ভূমিকা
নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কবি উত্তম দাশ তাঁর ‘হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ গ্রন্থে শ্রুতি সম্পর্কে কি লিখেছিলেন, দেখে নেওয়া যাক...
“শ্রুতি লেখকদের
প্রধান কাজ প্রকরণগত। বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলন যেমন তাদের শিক্ষিত করেছে নিজের
অভ্যন্তরে তাকাতে এবং দেশকাল সময়ের প্রেক্ষিতে অনিবার্য ছিল তা। সেই অবচেতন স্তরের
অলৌকিক অনুভূতি লৌকিক ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বর্জন করতে হয়েছিল যাবতীয় প্রচল
পদ্ধতি। শব্দের ধ্বনিগুণকে আবিষ্কার করলেন তাঁরা নতুনভাবে, শব্দের একক অর্থ,
স্পষ্ট ও অব্যর্থ। সেই সঙ্গে শব্দের চিত্রগুণ। ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের দুটি রূপ
দৃশ্য ও শ্রব্য। শব্দের একটি উপাদান বর্ণ, ধ্বনির সাংকেতিক চিহ্ন। অর্থাৎ একাধারে
সাংকেতিক ও দৃশ্যময়। ভাষা প্রচলনের পর থেকে বর্ণের এই দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ অবজ্ঞাত
হয়েছে, তাকেই নতুন মূল্যে আবিষ্কার করলেন ‘শ্রুতি’র লেখকরা। শব্দের আর একটি রূপ হলো ধ্বনিগত, উচ্চারণে ধরা পড়ে।
শব্দের এই দৃশ্যময় ও ধ্বনিময় রূপকে নবলব্ধ উপলব্ধির প্রকাশক হিসাবে প্রয়োগ, ফলত
নতুন দ্যোতনা পেল শব্দ। শব্দের অর্থগতরূপ
দৃশ্য ও ধ্বনিতে উদ্ভাসিত হয়ে অনেক অগম্য বোধের সহায়ক হলো। আবিষ্কৃত হলো ভাষার
নতুন মাত্রা।
‘শ্রুতি’ আন্দোলনকে বলেছি ইতিহাসের অনিবার্য পরিণাম।
আবেগ-সর্বস্ব উচ্ছ্বসিত বিবৃতিধর্মী কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের কথাকাহিনির পরিণতিতে
কাহিনীমূলক কবিতার জঞ্জালে বাংলাভাষা যখন ঘোর আবর্তে, একদল তরুণ তখন শুদ্ধ শরীরে
উপস্থাপিত করতে চাইলেন কবিতাকে। সমস্ত অশুচিতা বাঁচিয়ে একটা শুদ্ধ শরীর। শিল্পের
ধারক ও বহনকারী। শুধু চিৎকার আর মেদবর্ধনকারী কবিতা পাঠককেও ভুলিয়েছিল। কবিতা একটা
শিল্প মাধ্যম। বাণিজ্যের পসরা নয়, কবির আত্মগত উচ্চারণের বাণীরূপ, অন্তর্নিহিত
তাৎপর্যের প্রতীক; রহস্য উন্মেষকারী, দুর্জ্ঞেয় সত্যের প্রকাশক। সূক্ষ্ম শরীর তার,
শুদ্ধ ও পবিত্র। ‘শ্রুতি’
আন্দোলনের কবিরা পরিমিত শব্দ ও বাক্যবন্ধের কবিতার সেই শুদ্ধ শরীরের উপাসক। জটিল
সময়ে বসবাসকারী অথচ আত্ম-অন্বেষক একদল কবি শ্রুতি ও দৃষ্টির সমবায়ে ভাষার এক নতুন
সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলেন। নবজন্ম হল কবিতার। শুদ্ধ কবিতার।”
এটুকু
হয়ত বলাই যায়, বাংলা কবিতার অবয়বে যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এসেছে,কবিতার পংক্তির
১৪, ১৮ কিংবা ২২ অক্ষরের ঠাসবুনোন থেকে মুক্তি পেয়ে অক্ষরবৃত্তও যে দৃষ্টিনন্দন
হয়ে খেলা করছে কবিতায়। কবিতার বহিরঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে, তার জন্য শ্রুতির
কবিদের প্রচেষ্টাকে না মানাটা অন্যায় হবে। তার্কিকরা ১৯৬৫ সালের আগে কবিতার চেহারা
কেমন ছিল এবং পরবর্তী দু’এক
বছরে তা কিভাবে হঠাৎ বদলে গেল ভেবে দেখবেন। বাংলা কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষ
মুখোপাধ্যায়কে মনে রেখে শ্রুতির কবিরা যে পথ খুঁজতে চেয়েছিলেন তাকেই হয়ত আরো
সুন্দর করে তুলেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা। এখানে আমি শুধু দৃষ্টিনন্দন করার
কথাই বলছি।
১.
কোনো রকম ব্যাখ্যা, বিধান বা তত্ত্ব প্রচারের দায়িত্ব কবিতার নেই।
২.
ব্যক্তির কল্পনায় আন্তরিক অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির প্রকাশের ব্যক্তিত্বের পরিমণ্ডল
রচনাই কবিতা। তাই কবিতা হবে-ব্যক্তিগত, মগ্ন এবং একান্তই অন্তর্মুখী।
৩.
ভেঙে ফেলতে হবে সমস্ত প্রকার শাসন, ছিন্ন করতে হবে সংস্কারের সমস্ত বন্ধন।
শব্দকে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধের আবর্জনা থেকে এক এক করে বেছে নিতে হবে। তৈরি করতে
হবে ব্যক্তিগত এবং অনন্য, এক প্রচলমুক্ত বাকরীতি।
৪.
কবিতা চিৎকার নয়, নিবিষ্ট উচ্চারণ। কবিতা নির্মাণ নয়, শিল্পসৃষ্টি। কবিতা
বক্তৃতা বা প্রচার নয়, নিবিড় অভিজ্ঞতা। কবিতা বুদ্ধির চমক নয়, ব্যাকুল সন্ন্যাস।
৫.
অনুভবের অবলম্বন বিশেষ শব্দের গুরুত্ব অনুসারে তাকে অন্য শব্দের জুড়ে বা বেশি
স্পেস দিয়ে একেবারে আলাদা করে দেখানো। অথবা বিশেষ কোন শব্দকে সাধারণভাবে ব্যবহৃত
হরফ থেকে আলাদা হরফে ছাপিয়ে তার প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ। কখনো বা শব্দের
প্রতিটি বর্ণকে স্পেসের সাহায্যে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গানের লয়ের মতো উচ্চারণ
বৈশিষ্ট্য তৈরি করা।
৬.
ব্যাকরণের বিরোধিতা। ভাষা ব্যবহারে বাক্য প্রকরণের যুক্তি নির্ভরতার বর্জন।
শব্দকে বাক্যের অংশ বা পদ হিসাবে না ভেবে প্রতিটি শব্দকে একক গুরুত্বে ব্যবহার
করা। সংযোজক অব্যয়, ক্রিয়া বিশেষণ, বিশেষণ ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় ভারসৃষ্টিকারী
শব্দকে যথাসম্ভব পরিহার করা।
|
৪.
বাংলাদেশে এর কোন প্রভাব পড়েছিল কি?
সে
সময় বা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন ওপারের কোন পত্রিকা বা বই এদিকে আসতো না...তাই ঠিক
বলতে পারবো না এ বিষয়ে।
৫.
একই বাংলা সাহিত্যে অনেক খানি কাছাকাছি সময়ে হাংরি ও শ্রুতি আন্দোলন সাহিত্যে কি
এনে দিল?
‘মলয়বাবু বলেছেন আত্মার ইরিটেশন থেকে হাংরি
কবিতার জন্ম।’ ‘অস্তিত্বের অসহায়তায় নিমজ্জিত হয়ে ব্যক্তির
মধ্যে ডুব দিয়ে নিজের মানবসত্তার অর্থ খোঁজা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই’
এমনই বিশ্বাস ছিল হাংরি কবিদের। আবার বলি, প্রভাব নিয়ে কিছু বলার পাণ্ডিত্য আমার
নেই, গবেষকরা বলতে পারবেন। তবে সমস্ত আন্দোলনই কম বেশি কিছু দাগ তো রেখেই যায়।
৬.
ইন্টারনেট বর্তমান সাহিত্যকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?
ইন্টারনেট
পাঠকের কাছে পৌঁছোবার একটি সহজ উপায়। কিন্তু এত বেশি কবি-লেখকদের ভিড়ে, অধিকাংশ
লেখাই হারিয়ে যায় বলেই মনে হয় আমার... ফেসবুকে যশোপ্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়
কিনা জানিনা, পাঠক হিসেবে আমি কবিতারণ্যে দিশেহারা হয়ে পড়ি, ভালো কবিতা খুঁজতে
খুঁজতে ক্লান্তি এসে যায়। তবে, গুগল
পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ের সব মণি-মাণিক্য আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দেয়, এটাও তো পরম
পাওয়া।
৭.
সাহিত্যে দীর্ঘদিন তেমন কোন আন্দোলন চোখে পড়ছে না কেন ?
পৃথিবীর
সমস্ত আন্দোলনই সময়ের প্রয়োজনে এসেছে, প্রয়োজন ফুরোলেই শেষ হয়ে গিয়েছে...অকারণে
দীর্ঘস্থায়ী হয় না কোন আন্দোলন। নতুন দিগন্তের খোঁজে হাঁটতে গেলে যে সমর্পণ, যে
নিষ্ঠা, সময় প্রয়োজন...এই ব্যস্ত দুনিয়ায় সেটারই অভাব। চটজলদি, নগদ বিদায়ের পথেই
ভিড় বেশি। অথচ ইন্টারনেট এর যুগে যে কোন সৃষ্টিধর্মী আন্দোলন কত মানুষের কাছে
পৌঁছতে পারতো, যা আমাদের ক্ষেত্রে হয়নি।
৮.
বর্তমান সময়কে নিয়ে শ্রুতি আন্দোলনের ব্যাখ্যা কি ?
প্রচুর
কবিতা লেখা হচ্ছে, অনেক ভালো কবিতাও। তাৎক্ষণিক ভালোলাগার বাইরে দাঁড়িয়ে বলতে পারি
অসম্ভব ভালো কিছু কবিতা লিখছেন কয়েকজন। অন্যদের কবিতা স্মার্ট, ঝকঝকে। ভাষাও
অনবদ্য। তবু মনে হয় কি যেন একটা নেই। আত্ম-অন্বেষক কবিদের বেশি পছন্দ করি আমি।
৯.
আপনি নিজেকে কিভাবে শ্রুতি আন্দোলনের সাথে যুক্ত করলেন ?
আমরা
যখন কবিতা লিখতে আসি, তখন আমাদের সামনে ছিল বাংলা কবিতার দিকপালদের অসামান্য সব
সৃষ্টি। তিরিশের কবিরা তখন স্বমহিমায়। চল্লিশের কবিরা নিয়মিত লিখছেন। পঞ্চাশের
কবিরা তারুণ্যের ছোঁয়ায় বদলে দিতে শুরু করেছেন কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি। এ রকম
একটি কাব্যিক আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের কাব্যজীবন শুরু। তখন আমাদের কয়েকজনের মনে
হয়েছিল কবিতার জগতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গেলে আমাদের অন্যরকম লেখার কথা ভাবতে
হবে... আলাদা করতে হবে নিজেদের। এমনি এক অস্থিরতা থেকে, আমরা পাঁচজন- পুষ্কর
দাশগুপ্ত, পরেশ মণ্ডল, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্ত দাস ও আমি শুরু করি ‘শ্রুতি’।
১৪টি সংখ্যার সবগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম আমি...
১০.
তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনার মন্তব্য কি ?
নতুন
প্রজন্মের কবিরা যারা ইতিহাস ও পরম্পরা জেনে কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের কাছে অনেক
প্রত্যাশা। তাদের হাতেই বাংলা কবিতার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তাদের ভাষা, প্রকাশভঙ্গী,
চিত্রকল্প মুগ্ধ করে আমায়। মনে হয় ওদের কলমেই দীর্ঘজীবী হবে বাংলা কবিতা।
No comments:
Post a Comment