আধুনিক বাঙলা সাহিত্য দীর্ঘ পথ পাড়ি
দিয়ে এখন অন্তর্জাল
যুগে প্রবেশ করেছে । বর্তমানের
অন্তর্জাল ভুবনের দিগন্তে বাঙলা সাহিত্যের এই নতুন
পথচলাকে আমরা কীভাবে
পর্যবেক্ষণ করছি ? ওয়েব সাহিত্য সম্পর্কেই বা আমরা
কী ভাবছি ? কতটা টেকসই এই ওয়েবসাহিত্য ?
অন্তর্জাল সাহিত্য বলে আলাদা
কিছু হয় বলে
আমি মনে করি
না, অনেকেই করেন না । অন্তর্জালে
যারা লেখেন তারা বা তাদের পাঠককুল গ্রহান্তরের মানুষ নন । তবু এমন বলি, কারণ অন্তর্জাল আমাদের সাহিত্য প্রয়াসের নবীনতম মাধ্যম । সাহিত্য
মানে দুই মলাটের
ভিতর ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত গল্প উপন্যাস
নাটক, কবিতা ইত্যাদি, যা বিপণন হয়, আমরা কিনি অর্থের বিনিময়ে । আমরা
এইরকম ভাবতেই অভ্যস্ত। তার
একটা কারণ এই যে অন্তর্জাল এখনও সর্বত্রগামী
হয়ে ওঠেনি। তাকে
স্বাগত জানাতে এখনও লেখক
পাঠক-সাহিত্যকর্মীদের কিছু দ্বিধা আছে । সত্য বটে, স্মার্ট ফোন
এবং অন্তর্জাল সংযোগ সহজলভ্য হওয়ায় অনেক মানুষ
অন্তর্জাল ভুবনে প্রবেশ করতে পারছে, অতি সহজে এবং
সুলভে বিশ্বের তাবৎ পাঠ্যবস্তু
তার সামনে। প্রকাশমাধ্যম
হিসাবে অন্তর্জাল আজ অপ্রতিরোধ্য
জায়গায় চলে এসেছে
। সাহিত্য আর তার
থেকে মুখ ফিরিয়ে
থাকবে কী করে? অন্তর্জালের কল্যাণে বাঙলা সাহিত্যের পরিমাণগত বৃদ্ধি বিপুল,অন্তর্জালের
বিপণনও এখন অনেক
বেশি সহজসাধ্য । অজস্র বাংলা ওয়েব পত্রিকার
সাহিত্যপ্রয়াস দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে সারা বিশ্বে
ছড়িয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক
পাঠকের ঠিকানায়। লেখক
তাঁর সৃষ্টির পাঠপ্রতিক্রিয়াও জানতে পারছেন চটজলদি। সেই
বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির গুণগত মান কেমন
সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। অনেকেই বিশ্বাস করেন অন্তর্জাল
এখনও মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হয়ে উঠতে
পারেনি। তারা
বলেন, ছাপা বইয়ের গন্ধ কি কম্পিউটারের
কী বোর্ড বাহিত অক্ষরে পাওয়া যায়? মলাটবদ্ধ বই কেনা বা আলমারি
থেকে বের করে
বইপড়া, সংগ্রহে রাখা
আর বারবার পড়ার তৃপ্তি
কম্পিউটার বা স্মার্ট
ফোনের পর্দা দিতে পারে
না, পারবে না কোন দিনই- এমনই তাদের মত। অনেকেই
তাই মনে করেন
অন্তর্জাল এখনও সাহিত্যপাঠের
একটা চটজলদি বন্দোবস্ত। যারা
এমন মনে করেন
তাদের কিন্তু একটা বিষয়
মনে রাখতে হবে অন্তর্জাল
বা ওয়েবসাহিত্যের বয়স এখনও দশ পেরোয়নি। বলা যায় আমরা
এখন একটা বন্দোবস্ত
থেকে অন্য এক বন্দোবস্তে উত্তরণের সময়ে পৌঁছেছি
মাত্র ।
ছোট
পত্রিকা বা লিটল
ম্যাগাজিনকে বলি সাহিত্যের
আঁতুড়ঘর । ওয়েব
পত্রিকাগুলিও তাই । ‘লিটল ম্যাগাজিন’ ধারণাটার শুরু
হয়েছিল মধ্যপঞ্চাশ থেকে। প্রয়াত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৯৫৩তে ‘কৃত্তিবাস’ এর প্রকাশ থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের
পথচলার শুরু। তারপর
শহরে, গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য পত্র-পত্রিকার
প্রকাশ। অ-ব্যবসায়িক এই ছোট
পত্রপত্রিকাগুলি হয়ে উঠলো
বাংলা সাহিত্যের গর্ভগৃহ। এখনও
তাইই। এটা
মনে করা খুবই
ভ্রান্ত বলে আমি
মনে করি যে, অন্তর্জাল এর সামাজিক
পরিসরে সাহিত্য চর্চার বিপুল উন্মাদনায় মুদ্রিত ছোট পত্রিকাগুলির
প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে
গেছে বা তা বিপন্ন হয়েছে । বলা
ভাল, সাহিত্যচর্চার আর একটি শক্তিশালী প্রকাশমাধ্যম হয়ে উঠছে
এই ওয়েবপত্রিকাগুলি। অন্তর্জাল
পত্রিকা এখনই মুদ্রিত
পত্রিকার বিকল্প হয়ে উঠেছে
এমন হয়তো নয়, কিন্তু মুদ্রিত পত্রিকার চেয়ে অনেক
বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠা
যে অনিবার্য তা এখনই
বলা যায়। এখনও
আমরা মনে করি, ওয়েব পত্রিকায় একটা চটজলদি
ব্যাপার আছে। পাঠকের
একটা গল্প বা কবিতা পড়ার তৃপ্তি
অনেকটাই তাৎক্ষণিক, ওয়েব পত্রিকায় তারা একটা ভাল
গল্প বা কবিতা
কদাচই বারবার পড়েন। পাঠকের
ইচ্ছা হল আলমারি
থেকে পত্রিকা বের করে
তার ভালো লাগা
কবিতা আবৃত্তি করলেন বা গল্পটা
আবার পড়লেন, কিন্তু ওয়েব পত্রিকার ক্ষেত্রে এমনটি হবার নয়, এমন ভাবনাও ভ্রান্ত। কারণ, আমরা জানি গুগলের
সার্চ ইঞ্জিন মুহুর্তের মধ্যে আমার প্রিয়
লেখকের লেখা বা আমি যে লেখা
পড়তে চাইছি তা মুহুর্তের
মধ্যে খুঁজে দেবে। তাছাড়া
ওয়েব পত্রিকাগুলির সংরক্ষণাগারে ধরা থাকছে
তার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম ।
একুশ শতকের শুরুতেই দশ/বারো
বছরের মধ্যে ‘ব্লগ-বিপ্লব’ ঘটে গেছে । ই-জিন, ওয়েবজিন,
ব্লগজিন ইত্যাকার নানান অভিধায় অজস্র ওয়েব পত্রিকায় কবিতা, গল্প,
মননশীল প্রবন্ধ, ভ্রমণ-লেখ প্রভৃতি সাহিত্যের সবকটি শাখারই বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাবেশ আমরা দেখছি। প্রায় বিনা ব্যয়ে
একটি ওয়েব পত্রিকার
প্রকাশ সম্ভব; গুগল,
ওয়ার্ডপ্রেস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অতি সহজে
ও বিনা ব্যয়ে
অন্তর্জাল ব্যবহারকারীদের এই সুযোগ
দিচ্ছে, এমনকি তারা ওয়েব পত্রিকার ডিজাইন বা অঙ্গসজ্জাও
করে দিচ্ছে। ফলত
নবীন প্রজন্মের কাছে লেখালেখি
বা সাহিত্যচর্চার বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্জালে
এই যে সাহিত্যচর্চা,
এই যে ওয়েব
পত্রিকাগুলি বাঙলা সাহিত্যের গর্ভগৃহ হয়ে উঠেছে, তা সম্ভবই হত না কম্পিউটারে বাঙলা ব্যবহার প্রযুক্তির উদ্ভাবন না হলে। অন্তর্জালের ক্ষমতা আর অন্তর্জালে
বাঙলা চর্চার বিপুল সম্ভাবনার কথা উপলব্ধি
করেছিলেন বাংলাদেশের বন্ধুরা। এপারে
আমরা সে খবর
রাখতাম না। ব্লগ
বিপ্লব বা ওয়েব
পত্রিকার পরিচালনা শুরুর পর্বে তাদের প্রয়াসগুলিই এপারে আমাদের আদর্শ ছিল। ছাপাখানার
বাইরে বাঙলা ভাষা প্রথম
প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়েছিল ভাষাবিজ্ঞানী শহীদ অধ্যাপক
মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটারের জন্য উদ্ভাবিত
কীবোর্ড
‘মুনীর অপটিমা’র মাধ্যমে । সেটা
১৯৬৫ সালের কথা, তখনও কম্পিউটার আসেনি। এরপর
যার নাম করতে
হবে তিনিও এক মুক্তিযোদ্ধা
মুস্তফা জব্বার । ১৯৮৭র
১৬ই মে তিনি
কম্পিউটারে কম্পোজ করা বাংলা
সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আনন্দপত্র’ প্রকাশ
করেন। সম্ভবত
এটিই প্রথম বাঙলা ওয়েব পত্রিকা। পরের বছর মুস্তফা
জব্বার তৈরি করলেন ‘বিজয় বাঙলা’ কম্পিউটার লিপি। তবে অন্তর্জালে বাঙলা চর্চার বিপ্লব ঘটালেন ওপারের আর এক ভাষা প্রযুক্তিবিদ মেহেদি হাসান। দুহাজার
সালে তাঁর উদ্ভাবিত
অভ্র কী বোর্ডই
অন্তর্জালে বাঙলা চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী হয়ে উঠলো
। ওয়েবব্লগ ব্যক্তিগত হতে পারে, হতে পারে সম্মিলিত
বা সম্পাদিত। সম্পাদিত ওয়েবব্লগেরই পোষাকী নাম ওয়েবপত্রিকা,
যাকে নানান নামে চিনি- ওয়েবজিন, ই জিন,ই-পত্রিকা, ব্লগজিন ইত্যাদি। অন্তর্জাল
পত্রিকায় পৌঁছানোর আগে আর একটি স্বরের কথা বলতে
হবে, সেটি
‘ফেসবুক’ ।
তর্কের কোনো জায়গা নেই যে এখন বাঙালির সামাজিক জীবনে তার সৃজনশীল
মননে ‘ফেসবুক’
এর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য ও সর্বগ্রাসী। আমি এর সৃজনশীল
দিকটিই দেখবো। মানুষের
সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের দিগন্তবিস্তারী পরিসর আর কবেই
বা এমন উন্মুক্ত
হয়েছে। ফেসবুককে
কেন্দ্র করে গড়ে
উঠেছে কত সাহিত্যগোষ্ঠী। আর এই যে অগুনতি ওয়েবভিত্তিক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে তার টার্গেট
পাঠকের একটা বড় অংশই ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ।
মুদ্রিত মাধ্যমে
সাহিত্যচর্চায় যারা প্রতিষ্ঠা
পেয়েছেন বা পাবেন
বলে মনে করেন
তারা অন্তর্জালের সাহিত্যপ্রয়াসকে কিঞ্চিৎ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য
করেন, নিজেরাই নিজেদের
শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসান, বলা ভালো ওয়েবসাহিত্যের বিরোধিতাই করেন। তাদের
মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে
যে বাংলায় ছাপাখানা আসার পর মুদ্রিত সাহিত্যপ্রয়াসের আদিপর্বেও এমন বিরোধিতা
হয়েছিল। রক্ষণশীলরা
মুসলমানদের তৈরি কাগজ
কালিতে তাদের দ্বারা মুদ্রিত হবে ধর্মগ্রন্থ
এটা মানতে চাননি। ছাপাখানা
থেকে এমন বিজ্ঞাপনও
করা হত যে গঙ্গাজলে বিশুদ্ধ করা কালি
ও কাগজে ব্রাহ্মণ দ্বারা মুদ্রিত ইত্যাদি। রক্ষণশীলরা
স্বাগত জানাননি, ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন পুঁথির জগৎকে। আজকের
ওয়েবনির্ভর সাহিত্যের বিরোধিতাকে বিচার করবো সেই
পরিপ্রেক্ষিতে। অন্তর্জাল
বাঙলা সাহিত্যকে বিশ্বের তামাম প্রান্তে পাঠকের ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে। স্বভাবতই
লেখাও হচ্ছে প্রচুর। আজেবাজে
লেখাও যে হচ্ছে
না তা নয়। সে তো মুদ্রিত
পত্রিকাতেও হয়। এক্ষেত্রে
সম্ভবত ফেসবুক নামক সামাজিক
পরিসরের নানান গ্রুপে সাহিত্য প্রয়াসের কথা মনে
আসবে। সেখানে
লেখার সম্পাদনার কোন সুযোগ
নেই। লেখকরা
লিখছেন নিজেরাই প্রকাশ করছেন, কোন বাধা নেই। পাঠকও
পড়ছেন, মতামত দিচ্ছেন। ফেসবুকের সাহিত্য গোষ্ঠীগুলিকে ওয়েবপত্রিকা বলা যায়
না ঠিকই, কিন্তু সেখানে প্রকাশিত লেখাগুলি সাহিত্যতো বটে। তারাই
তো ওয়েব পত্রিকাগুলিতে লিখছেন, ব্লগে লিখছেন।
অন্তর্জালের সামাজিক
পরিসরগুলি লেখককুলের শ্রেণী বৈষম্য মিটিয়ে দিয়েছে। এখানে ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরাণীর কোন ভেদ
নেই’। সেটা কোন চিন্তার বিষয় বলে
আমি মনে করি
না। চিন্তার
বিষয় বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অধোগামিতা । তার
সমাজ ও সময়
বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বোপরি
তার ভাষার সঙ্গে অনাত্মীয়তাই চিন্তার বিষয়। সাহিত্য
তো সবটাই ভাষানির্ভর। আমাদের
দৈনন্দিন জীবনে সেই বাংলা
ভাষাটার ব্যবহারিক প্রয়োগ এখন কতটা
চিন্তাজনক সে সম্পর্কে
আমরা ওয়াকিবহাল। বিশ্বায়ন
ও পণ্যায়ন আমাদের দিয়েছে অনেক, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং
সযত্নে লালিত
সামাজিক ও মানবিক
মূল্যবোধের শিকড়টাকেই আলগা করে
দিয়েছে। তাই
যদি কেউ মনে
করেন অন্তর্জালের সাহিত্য-প্রাচুযের্র মধ্যে
শিকড়হীন সাহিত্যেরও যথেষ্ট চাষ-আবাদ
হচ্ছে সেটাই বা মিথ্যা
বলি কী করে ? সে সাহিত্যে এলোমেলো বিষয়ভাবনায় থাকছে না ভাষার
সৌকর্য, ব্যকরণের অনুশাসন
ও ভাবনার সমৃদ্ধি। একেই
বোধহয় বলা যায় ‘সাহিত্যক্ষেত্রের নিরক্ষরতা’ । ভাষা ও সাহিত্যকে
বিন্দুমাত্র জানার চেষ্টা না করা, পূর্বসুরিদের লেখা না পড়া এবং সমকালীন
সমাজ ও সময়কে
না জানাকেই আমি বলবো ‘সাহিত্যক্ষেত্রে নিরক্ষরতা’ । কিন্তু এটা যে শুধু ওয়েব নির্ভর
সাহিত্যে ঘটছে এমন
নয়। তবে
সবটাই ‘না-সাহিত্য’ বা কিছুই হচ্ছে না বলে
হতাশা প্রকাশে রাজি নই। অভিজ্ঞতা বলছে ওয়েব
পত্রিকাগুলি থেকে যে বিপুল সংখ্যক কবি, গল্পকার উঠে
আসছেন তার গুরুত্ব
অসীম। কবিতার
কথাই বলি। অন্তর্জাল
যখন ছিল না তখন কাব্যগ্রন্থের বিপণন কেমন ছিল, কতজনইবা গ্রন্থাগারে গিয়ে কবিতার
বই খুঁজতেন? আজ কিন্তু ফেসবুকের সাহিত্য গ্রুপগুলিতে ও ফেসবুককেন্দ্রিক ওয়েব পত্রিকাগুলিতে প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঠকরা
তা পড়ছেন, লেখক চটজলদি তাঁর লেখার পাঠপ্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন। এ জিনিস তো আগে
ছিল না । অন্তর্জাল সাহিত্য-চর্চার
বিপুল উন্মাদনা লিটল ম্যাগাজিন
আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে বিপন্ন করতে পারে
এমন মনে করাও
ভুল। বরং
মনে করি, ওয়েব মাধ্যম মুদ্র্রিত মাধ্যমের পরিপূরক হয়ে উঠতে
পারে । উঠতে
পারে নয়, উঠবে। এখন অনেক ‘ফেসবুক গ্রুপ’ যেমন মুদ্রিত
পত্রিকা প্রকাশ করছে, অনেক মুদ্রিত ছোট পত্রিকাও অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরে তার উপস্থিতি
জাহির করছে ‘ফেসবুক গ্রুপ’ বা ‘পৃষ্ঠা’
বানিয়ে। আমার
বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে
হয়তো অনেক ছোট
মুদ্রিত পত্রিকা বা লিটল
ম্যাগাজিনের অন্তর্জাল সংস্করণও দেখতে পাবো। মুদ্রিত
ছোট পত্রিকার একটা ব্রত
থাকে পত্রিকাটিকে রুচিসম্মত ও সাহিত্যগুণান্বিত করার। সেই একই
ব্রত ওয়েব পত্রিকার
ক্ষেত্রেও থাকা উচিৎ
।
অন্তর্জাল বা অন্তর্জাল সাহিত্য যেমন আকবর
বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরাণীর ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে, তেমনই ভেঙেছে ভৌগোলিক সীমানার বেড়া। অন্তর্জাল
বা অন্তর্জাল সাহিত্যের কোনো ভৌগোলিক
সীমানা হয় না। তবে একথা মানতেই
হবে ওপার বাংলায়
ব্লগ চর্চা অনেক বেশি। ওপারের তরুণরা ব্লগ বা ওয়েব ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেন অনেক
বেশি। এপারের
লেখকরা যেমন লিখছেন
সেই সব ব্লগে
ওপারের সাহিত্যকর্মীরাও এপারের ওয়েব পত্রিকাগুলিকে সমৃদ্ধ করছেন। আর এটা তো অস্বীকার
করার কোন জায়গা
নেই যে বাংলা
ভাষার প্রতি ওপারের আবেগ কয়েকগুণ
বেশি এপারের চেয়ে। সাহিত্যের
এই আদানপ্রদান নিশ্চিতভাবেই অন্তর্জালের অবদান। ইতিহাসের
করুণ কিন্তু অনিবার্য পরিণতি- একই জাতিসত্ত্ব¡ার, একই ভাষাভাষী মানুষের পৃথক ভৌগোলিক
পরিচিতি। সংশয়
নেই যে অন্তর্জালের
দিগন্তপ্রসারী ব্যাপ্তি মানুষের মধ্যে সমাজ ও সাহিত্য ভাবনার বিনিময়ের পরিসরটিকে সহজ ও ব্যাপকতর করেছে। দুই
বাংলার লোকায়ত এবং জীবনবোধে
উজ্জ্ব¡ল গণতান্ত্রিক
ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যভাবনার আদান-প্রদানই
এই পরিসরটিকে অর্থবহ করে তুলতে
পারে বলেই আমার বিশ্বাস
।
ওয়েব পত্রিকার লেখার গুণমান নিয়ে অনেকেই
প্রশ্ন তোলেন। শুধু
ওয়েব পত্রিকাকে দোষ দিয়ে
লাভ নেই। সমাজ
যেমন, তার সাহিত্যও তেমন। আমাদের
মূল স্রোতের সাহিত্য এখন আর জীবন ও জগৎ
সম্পর্কে প্রগাঢ় সমবেদনার শব্দ শোনায়
না, মানুষকে বেদনার
কেন্দ্রে রাখে না, নতুনতর জীবনবোধের স্বপ্ন দেখায় না। শোনায়
শুধুই সুখী সুখী
মানুষের নিজের জন্য, আজকের জন্য বাঁচার কথা। শুধু
সাহিত্যই বা কেন? আমাদের চলচ্চিত্র, সংগীত,
নাটক সবগুলি ক্ষেত্রেই তো পণ্যায়নজাত
ভোগবাদী ভাবনার অনিবার্য জয়ধ্বনি। ‘রক্তকরবী’ নাটকে
অধ্যাপক ও নন্দিনীর
কথোপকথনের অংশ মনে
পড়ে। অধ্যাপক
নন্দিনীকে বলছেন “আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা
করি । তার
প্রেতকে বশ করতে
চাই। সোনার
তালের তাল-বেতালকে
বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর
মধ্যে”। এখন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পেয়েছি। এখন
প্রেম, ভালোবাসা, সমবেদনা
আর বিশ্বাস- সবই বিকোচ্ছে, আর ‘বাজার’
বন্দী আমাদের সৃজনভূমির সর্ব-অঙ্গ। আমরা জানি না এই দম বন্ধ
করা অবস্থাই আমাদের আগত অনন্তকালের
ভবিতব্য কি না !
তবু
আশাবাদী হতে ইচ্ছে
হয় যে বিশ্বাসের
একটা ভিত্তিভূমির নির্মাণ হবে, যেখানে দাঁড়িয়ে সমাজ ও জীবনের
প্রতি প্রগাঢ় সমবেদনার প্রতিভাষ দেখতে পাবো আমাদের
সৃজনভূমির সর্ব অঙ্গে। নবীন প্রজন্মই সেই দায়
তুলে নেবে।
No comments:
Post a Comment