বিহান,
বর্ষ ২ সংখ্যা
১: তিন গল্পকারের গল্প ও গল্পকথার
সমন্বয়ে গড়ে ওঠা
এক সাহিত্যপত্রের অবয়ব। গল্পকার
শাহীন আখতার, হামীম কামরুল হক, হামিম কামালের ছোটগল্পবিষয়ক লেখকভাবনা ও সেসাথে
তিনটি চমৎকার ছোটগল্পের উপস্থাপনে নিরীক্ষাধর্মী এই কাগজটি
ছোটগল্প নিয়ে পাঠকের
বেশকিছু ভাবনা উসকে দেয়। উদ্বাস্তু জীবনের নানা সংকট, নিম্ন মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-আশার
টানাপোড়েন, জটিল জীবনদৃষ্টির নানামুখী বিশ্লেষণ নিয়ে তৈরি
হয়েছে এসব গল্পের
পৃষ্ঠপট। লেখকত্রয়
অপার মমতা আর ভাষিক দক্ষতা দিয়ে সম্পন্ন
করেছেন কিছু মানুষের
বহির্জগত ও অন্তর্জগতের
নিপুণ চিত্রণ।
’অলৈাকিক ছড়ি’ গল্পে লেখক শাহীন আখতার স্বদেশচ্যুত, বাস্তুহারা, দুর্দশাগ্রস্থ,
শরণার্থী মানুষের ছবি এঁকেছেন
কিছু ধর্মীয় মিথকে অবলম্বন করে। বর্মী
সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতনে দেশছাড়া , দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ক্ষুধাকাতর,
যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষের প্রতিনিধি মুসা নামের
এক রোহিঙ্গা বালক অলৈাকিকতায়
আশ্রয় খোঁজে। এক অদ্ভুত মানসিক ভাবনা তাকে চালিত করে। ধর্ম
কাহিনীতে বর্ণিত নবী চরিত্র
মুসা’র নামের সাথে মিলিয়ে
তাঁর নাম, যে মুসা তাঁর অলৌকিক ছড়ির আঘাতে
সাগরকে দ্বিখন্ডিত করে রাস্তা
তৈরি করেছিল; যে রাস্তায় অনুসারীদেও নিয়ে অত্যাচারী
শাসক ফেরাউনের রাজ্য থেকে বেরিয়ে
এসেছিল।
নবী মুসার মতোই ’মোজেজা’
দেখানোর কল্পনা করে রোহিঙ্গা
উদ্বাস্তু বালক মুসা। সে স্বপ্ন দেখে এমন
এক ছড়ি প্রাপ্তির, যা নিমেষে সাপ হয়ে
শত্রুকে তাড়া করবে, তাড়া খেয়ে আরাকান
থেকে পালাবে অত্যাচারী বর্মী সেনা। যদিও ‘মোজেজা’ তাঁর হাতে আসে না-
দু’দিন, দু’রাত। পারাপারের
নৌকার দেখা নাই। পেছন থেকে তাড়া
করছে ফেরাউনের বাহিনীর মতো বর্মী
সেনা। তখর
সবার অগোচরে মুসা একবার
দরিয়ার দিকে হস্ত
বিস্তার করেছিল। কাজ
হয় নাই। ‘এরপর রাত নামলে হাতের লাঠিটাই ছুড়ে মারে
পানিতে। এবারও
বিফল হয়।’
তবুও মুসা তাঁর স্বপ্নকে জিঁইয়ে রাখে। রক্ত, মৃত্যু আর ধ্বংসের
দুঃসহ স্মৃতিকে সঙ্গে করে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর পথযাত্রা, এপারের অচেনা মুলুকে ক্যাম্পের উদ্বাস্তু জীবন, পাচারকারী জঙ্গিদের
নানা প্রলোভন- সবকিছু ছাপিয়ে মুসার ভাবনায় শুধু সেই
মোজেজাই খেলা করে; মোজেজা প্রদর্শনে ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই
গল্পটি শেষ হয়।
নিয়ত পড়ে পড়ে মার খাওয়া, জীবন-মৃত্যুর
সতত টানাপোড়েনের মধ্যেও মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে
চায়, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে কোনোকিছুকে
অবলম্বন করে। মুসার
অলৌকিক ছড়ির স¦প্নযাপনের মধ্য দিয়ে
গল্পকার এই সত্যটিরই
প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কিছু অনালোকিত অথচ জীবনস্পর্শী বিষয় জটিল
কিন্তু নান্দনিক উপস্থাপনায় বেরিয়ে এসেছে হামিম কামালের গল্প ‘ফাঁদ’
এ। মানবজীবনের
কিছু ভাবনার অন্তর্বিশ্লেষণকে উদ্দেশ্য করে লেখা
এই গল্পে লেখক তাঁর
ভাষায়, নিজের কিছু দার্শনিক বোঝাপড়াকে অবয়ব দিতে
চেয়েছেন। বিপ্লব-অভিলাষী, আত্মগোপনে থাকা
এক তরুণী এক নির্জন
ঘরে জীবনভাবনা আর আত্মবিশ্লেষণের টানাপোড়েনে কাল কাটায়। নিবিষ্ট
সেই ভাবনায় দেখা যায়
এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। তরুণীর
সাথে বৃদ্ধের কিছু দার্শনিক
কথোপকোথন আর রহস্যময়
এক পরিবেশের চিত্রকল্প নিয়ে গড়ে
উঠেছে এই গল্পটি। চিত্রকল্পের শরীরে বাস্তব থেকে অধিবাস্তবের
রংতুলির ছোঁয়া এক অনন্য
শিল্পরূপ দিয়েছে গল্পটিকে। কখনো
বিপ্লবী রাজনৈতিক দর্শন, মনস্তত্ত্ব, কখনও
অবচেতন মনের এলোমেলো
ভাবনা বাঙময় হয়ে ওঠে
দু’জনের
কথোপকথনে। আবার
গল্পকারের চমৎকার শিল্প কৌশলে কোনও কোনও
সময় দুই চরিত্র
এক হয়ে যায়
এক তরুণীর মধ্যে- সংলাপগুলো মনে
হয় একজনের স্বগতোক্তির মতো।
সংলাপে গভীর, জটিল ভাবনা
বিশ্লেষণ, ব্যক্তিস্বরূপের উন্মোচনে
দার্শনিক ব্যাখ্যা, চরিত্র ও পরিবেশ চিত্রণে রহস্যময়তা এই গল্পটিকে
বেশ খানিকটা দুর্বোধ্য করে তুলেছে।
গল্পের চরিত্রের নাম’ সিনেমায় টুকটাক
কাজ করা যুবক’। এই যুবকটির যাপিত জীবনের, বিশেষত অন্তর্জীবনের নানা যন্ত্রণাবোধ, স্বপ্ন-আশার দোলাচল এক ধরনের
যাদুবাস্তব ভাবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত
হয় হামীম কামরুল হকের গল্পে, যার নাম ‘বাস্তবের গলনাংক’। নায়ক
হতে চাওয়া এক তরুণ
অভিনয়ে ভালো না হওয়ার কারণে সিনেমা পাড়ায় নিজেকে ঠিক সেভাবে
দাঁড় করাতে পারে না, কিন্তু ঐ পাড়ায়
থাকার তীব্র বাসনা, রঙিন জগতের রঙিন মেয়েদের সঙ্গলাভের মোহ, ছোটোখাটো প্রাপ্তির
সুখস্মৃতি তাঁকে ঐ পাড়াতেই
আটকে রাখে। আরেকদিকে
ঘরে অসুস্থ, শয্যাশায়ী, বৃদ্ধামায়ের
দেখাশুনা করা, তাঁর কথা ভেবে সংসারী হওয়ার ইচ্ছে, আবার সেই ইচ্ছের মধ্যে মা-বৌয়ের
সম্পর্কের জটিলতার কথা ভেবে
দোটানায় পড়া, সব মিলিয়ে টানাপোড়েন আর কাটে
না। বৌ আনতে সাহস হয় না, সুন্দর,
প্রাণচাঙ্গা করা সোজা
কথা চার্মিং মাইয়া ছাড়া সে বিয়ে করবে না, অন্যদিকে সেই বউকে
তার মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে
চলতে হবে, এই দুই শর্ত কোনো তালেই
খাপ খায় না, এই সদাপ্রবাহমান টালমাটাল ভাবনার মধ্যে একদিন অপরূপ এক মেয়ের
দেখা পায় যুবকটি-
কয়েনটা তুলতে গেলে, সে দেখতে পায় এক অসামান্য
পা, ছুঁচালো পায়ের
আঙুল ও পায়ের
গোলাপি আভা দেখে
উপর দিকে তাকাতে
গিয়ে, শাড়িপড়া এক মালকিনের মুখে তার
দৃষ্টি গিয়ে থামে
এবং সে বুঝতে
পারে, এমন সুন্দর মুখ ইহ জগতে
সে আর দেখে
নাই,
যুবকটির ঘোর
লাগা শুরু এখান
থেকেই; আর গল্পের বাস্তবও গলতে শুরু
করে এখানেই। গলে
যাওয়া বাস্তব কণার সাথে
মিশতে থাকে যাদুর
উপাদান। জগতের
সবচেয়ে সুন্দর পা, আর মুখের ছবিস্মৃতি নিয়ে তন্ময়
হয়ে থাকা যুবকটি
দিনরাতের হিসাব ভুলে যায়। তাঁর যাপিত সময়, কাজকর্ম,
মায়ের দেখাশুনা, সামাজিক যোগাযোগ-সবকিছুতেই একটা দুর্বোধ্যতা,
রহস্যময়তা রেখে যান
গল্পকার।
তবে যতই যাদুকরী মনে হোক
না কেন, আদতে বাস্তব সংলগ্নতাই এই গল্পের
প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাস্তব
আর যাদুর মিশেলে এক ধরনের
আলো-আঁধারী বোধ
বিস্তার করা এই অনবদ্য গল্পটিতে সিনেমায় টুকটাক কাজ করা
যুবকটির বাস্তব টানাপোড়েনের জীবনটাই চিত্রিত হয়েছে। জাদুবাস্তবতার শিল্পপ্রয়োগ এখানে যুবকটির বহির্জগতের সাথে একটি
যোগসূত্র স্থাপন করেছে- সেটা পাঠকের বোধে নাড়া দেয়, পাশাপাশি পাঠকের চোখে নিম্নমধ্যবিত্তের যন্ত্রণাভরপুর বাস্তব জীবনের ছবিও স্পষ্ট
হয়ে ওঠে।
এই তিন গল্পকারের গল্পে সাধারণ মানুষের অন্তর্জীবনের অসাধারণ বিশ্লেষণ পাঠককে স্পর্শ করে তাদের
শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে। তবে
অন্তর্জীবন, বিশেষ করে মানসলোক এখানে প্রাধ্যান্য পেলেও গল্পের বিষয়বস্তু, ভাবকল্প,
চরিত্র ও পরিবেশচিত্রণ-
সবকিছু হয়েছে রূঢ় বাস্তবতাকে
ঘিরেই। মানবজীবনের
পৃষ্ঠপটের বাস্তবতা আর অন্তর্গূঢ়
রহস্যময়তা এখানে হাতে হাত
ধরে চলে পাশাপাশি। আর অনন্য শিল্পকৌশলে এই দুয়ের
সহাবস্থানকে উপস্থাপনের কারণেই গল্পগুলি হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে।
ভুল
সংশোধন :
বিহান সংখ্যা-৩ (গল্প সংখ্যা) এ হামিম
কামাল নামটি ভুলক্রমে হামীম কামাল ছাপা হয়।
এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে আমরা বিশেষভাবে
দুঃখিত।
No comments:
Post a Comment