প্রারম্ভ:
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ
সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
কথাগুলি রবি
ঠাকুর লিখেছিলেন ছোটগল্প প্রসঙ্গে। কেন
জানিনা মনে হয়, এই একই কথা
লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। লিটল
ম্যাগাজিন, যা বাঙালীর আত্মানুভূতির বহুরৈখিক প্রাণস্পন্দন।
বাঙালীর সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গ এলে যে নামটি
সর্বাগ্রে আসে, সে ঐ লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ। প্রচলিত সাহিত্যধারার বাইরে মুক্তচিন্তা ও আন্দোলনের
ফসল এই লিটল
ম্যাগাজিন। আর মোরা একই বৃন্তে
দুটি কুসুমের ন্যায়, বাংলা সাহিত্যের ধারাবদলের প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি সংযুক্ত হওয়া আরও
একটি নাম, ওয়েবসাহিত্য বা ওয়েবজিন, যাকে আমরা লিটল ম্যাগাজিনেরই এক্সটেনশন ভাবি, যা আদ্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর হয়েও আচারে
আচরণে লিটল ম্যাগাজিনই। নিঃসন্দেহে
বহুধা বিভক্ত এই আধুনিকতার
সাথে তাল মেলাতে
গিয়েই এ তারুণ্যের
নব্য প্রকাশ, উদীয়মান সূর্য
বা চাঁদকে লালন করার
এক নতুন গ্যালাক্সিঃ
ওয়েবজিন। স্বভাবতই
লিটল ম্যগাজিন আন্দোলন ও ব্যাপ্তির
একশ বছরের বেশি সময়
ধরে তার ঐতিহ্য
লালন করে এলেও
ওয়েবভিত্তিক সাহিত্যের বয়স নিতান্তই
অল্প। হাতের
মুঠোয় বিশ্ব এনে দিলো
অন্তর্জাল। আর দুনিয়ার সাহিত্যকে এক প্ল্যাটফর্মে
এনে ফেললো ওয়েবভিত্তিক সাহিত্যচর্চা। ওয়েবজিন
প্রসঙ্গে জেনে নেওয়ার
আগে জেনে নেওয়া
প্রয়োজন লিটলম্যাগের কথা। প্রদীপ
জ্বলার আগে : লিটল ম্যাগের ইতিহাস ও ভূগোলঃ
‘ম্যাগাজিন’ শব্দের অর্থ অস্ত্রভান্ডার। তবু
এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছিল
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের পাশ্চাত্য সাহিত্য সমাজ। শব্দটি
ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছিল, সাহিত্য যা হবে
অস্ত্রের মত তীব্র
ও ধীশক্তি সম্পন্ন এবং যা মানুষের কথা বলবে। বিশ্বজোড়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্য হয়ে উঠবে
অসাম্য নিরসনকারী হাতিয়ার। এছাড়া
লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে একথাও মনে রাখা
জরুরী যে এই কাগজ সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক, আদর্শবোধ সম্পন্ন
পত্রিকা। এটি
নতুন কিছুর দিক নির্দেশক। অর্থাৎ সাহিত্যের নবচেতনাকে নিয়ে এগিয়ে
যাবার নাম লিটল
ম্যাগাজিন। সনাতনী
সাহিত্যচর্চার বাইরে বলে সেখানে
সৃজনশীল লেখাগুলোর যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগও থাকে ফলে
এর মাধ্যমে শক্তিশালী লেখক তৈরি
হয়। লিটল
ম্যগাজিন বা ছোট
কাগজের আদর্শগত ভূমিকা ছাড়াও এটি সাধারণত
প্রতিষ্ঠানবিরোধী, প্রথাবিরোধী, কেন্দ্র
বিমুখ, তারুণ্য ও নতুন চিন্তার প্রসারের ক্ষেত্র।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ‘ডায়াল’
The Dial ( বোস্টন, ১৮৪০-৪৪) নামক লিটল ম্যাগের জন্ম হয় মার্গারেট ফুলার ও আর রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসনের যৌথ সম্পাদনায়। লিটল ম্যাগাজিনের আরেক প্রভাবশালী
পত্রিকা ছিল ইংল্যান্ড
থেকে প্রকাশিত Savoy ভিক্টোরিয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার উদারপন্থী ও সাম্যবাদী
লেখকদের প্রধান বাহন ছিল
এই স্যাভয়। উনবিংশ
শতাব্দীর শেষ এবং
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে
ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং
ফ্রান্সে লিটল ম্যাগাজিন
জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কালক্রমে তা লড়াইয়ের
হাতিয়ারও হয়ে উঠতে
থাকে। লিটল
ম্যাগাজিন Poetry: A Magazine of
Verse (শিকাগো
১৯১২) এর সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড। পরবর্তীতে
জেমস জয়েস, টি এস এলিয়ট, হেমিংওয়ের ন্যায়
প্রভূত বিখ্যাত সাহিত্যিক লিটল ম্যাগাজিন
দিয়ে যাত্রা শুরু করে
কালজয়ী সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন।
বাংলায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের সূচনা হয় প্রমথ
চৌধুরীর হাত ধরে, ১৯১২-১৪ সালের মধ্যে, ‘সবুজপত্র’ নামে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই পত্রিকার
নিয়মিত লেখক ছিলেন। যদিও ১৮৫৬-৫৯ এর মধ্যে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনকেও কেউ কেউ
প্রথম বাংলা লিটল ম্যাগাজিন
বলে আখ্যায়িত করেন।
বাংলাদেশে ১৯৪৭
সালে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব-উল-আলম
চৌধুরী ও সুচরিতা
চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সীমান্ত (১৯৪৭-৫২)। ফজলে
লোহানীর সম্পাদনায় ১৯৪৯ সালে
বের হয় অগত্যা। ১৯৫৭ সালে আসে
সিকানদার আবু জাফর
সম্পাদিত সমকাল। শনিবারের
চিঠি, কল্লোল,
সওগাত, চতুরঙ্গ,
কালি কলম, স্বাক্ষর, কণ্ঠস্বর, সাম্প্রতিক, কবিতা,
কৃত্তিবাস, কবিকণ্ঠ,
সমকাল, উত্তরণ,
বক্তব্য, স্যাড জেনারেশন প্রভৃতি বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কিছু লিটল
ম্যাগাজিনের নাম। তাহলে
বলা যায় লিটল
ম্যাগ বাংলা সাহিত্যের সূতিকাগার। প্রগতিশীল
বাংলা সাহিত্যধারার এইসব সাহিত্য
পত্রিকা সাহিত্য আন্দোলনে নতুন গতির
সঞ্চার করেছে বারবার এবং তরুণদের
স্বপ্নকে লালন করে
সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। যদিও
আর্থিক দুর্বলতা, সক্রিয় কর্মীর অভাব, অপেশাদারি মনোভাব
লিটল ম্যাগাজিনের পথ চলায়
বরাবরই অন্তরায় হয়ে ওঠে
ফলে বহু লিটল
ম্যাগাজিন দীর্ঘমেয়াদী হয়ে উঠতে
পারেনি কখনও তাই
হয়ত নামকরণেই সে ‘লিটল’।
ওয়েবজিনের ঠিকুজিকোষ্ঠীঃ
যে কোনো সাহিত্যচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় পাঠক। লিটল
ম্যাগের ক্ষেত্রেও সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু
একুশ শতকের শেষদিক থেকে ইন্টারনেট
নামক আধুনিক বিপ্লব ও বিশ্বব্যাপী
সাধারণ মানুষের মুঠোয় বিশ্বদর্শন পৌঁছে দেওয়ার অস্থির প্রক্রিয়া সাধারণ সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের পাঠাভ্যাসকে দূরে ঠেলতে
থাকে। প্রযুক্তির
দ্রুত বিকাশে, মানুষের কাছে
ইন্টারনেটের ব্যবহার যখন ধীরে
ধীরে সহজ হয়ে
উঠছে সেসময়ই গোটা দুনিয়া
জুড়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়, কী করে পাঠকদের
বিশুদ্ধ সাহিত্যের আঙিনায় ধরে রাখা
যায়। ইলেকট্রনিক
মিডিয়া আর ইন্টারনেটের
মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণসংযোগের যে সুযোগ
তৈরি হয় তার
ফলে সাহিত্যে যুক্ত হয় নতুন
চিন্তা। এ প্রেক্ষিতে সাহিত্য চর্চায় যুক্ত হল ওয়েবসাহিত্য।
এবার দেখা যাক অন্তর্জালে সাহিত্যের শুরু কীভাবে
হয়েছিল।
আজকের ওয়েব সাহিত্যচর্চার পিছনে তাকালে খুব পরিচিত
যে শব্দটি ভেসে ওঠে
তা হলো ব্লগ। প্রথম দিকে ব্লগ
বলতে ডিজিটাল ডায়েরি লেখা অর্থেই
ধরা হত। শিকাগোতে
জন্মগ্রহণকারী জাস্টিন হল ১৯৯৪
সালে ‘লিস্কস ডট নেট’ নামে একটি পার্সোনাল হোমপেজ তৈরি করেন
যা প্রথম ব্লগ হিসেবে
বিবেচিত। পরবর্তীতে
১৯৯৭ সালে আমেরিকায়
জর্ন বার্গার ‘রোবট উইসডম’ নামে ওয়েবব্লগের
সূচনা করেন। ১৯৯৯
সালে পিটার মার্লহোজের মাধ্যমে ওয়েবব্লগ নামটি ছোট হয়ে
ব্লগে রূপান্তরিত হয়ে যাত্রা
শুরু করে। ১৯৯৯-এর মার্চে ব্র্যাড ফিটজপ্যাট্রিক শুরু করেন
লাইভ জার্নাল। এরই
ধারাবাহিকতায় ইভান উইলিয়ামস
এবং মেগ হুরিহান (পাইরা ল্যাবস) ব্লগার.কম চালু করেন
আগস্ট, ১৯৯৯-এ এবং ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারিতে গুগল তা কিনে নেয়।
ব্যক্তিকথন, সাহিত্যবোধ,
মূল্যবোধ, নানাবিধ বিষয়ে
ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কথা নিয়ে
এর যাত্রা শুরু হলেও
দ্রুতই এসবের সাথে যুক্ত
হতে শুরু করে
বিভিন্ন সৃজনশীল লেখা, রাজনৈতিক মতামত, ইতিহাস আলোচনা, মন্তব্য কলাম, গল্প, কবিতা,
সাহিত্যনির্ভর বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা।
সোশ্যাল মিডিয়া
ও ওয়েবসাহিত্য :
২০০০ সালের পরবর্তীতে জন্ম নেয়
সোশ্যাল মিডিয়া। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে চালু হয় সহমতাবলম্বী লেখকদের বিবিধ গোষ্ঠী ও সামাজিক
মাধ্যম : অর্কুট,
হাই ফাইভ, মাই স্পেস, ফ্রেন্ডস্টার ইত্যাদি। পাশাপাশি
শুরু হয় ফোরাম
ভিত্তিক মত আদানপ্রদানের
জায়গা। যদিও
শুরুতে ইন্টারনেট একেবারেই পাশ্চাত্য মাধ্যম হিসেবে শুরু হলেও
দ্রুত বাংলাভাষাভাষীরাও নিজের ভাষায় মত আদানপ্রদান
ও লেখালিখিতে সক্ষম হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে তরুণ
প্রযুক্তিবিদরাই এ কাজে
এগিয়ে এসেছিলেন। ইন্টারনেটে
বাংলাকে সহজভাবে প্রকাশ করার জন্য
উনিশ বছরের তরুণ মেহেদি
হাসান ২০০৩ এ ‘অভ্র’ রিলিজ করার মাধ্যমে ডিজিটাল দুনিয়ায় বাংলা ভাষার চর্চাকে ছড়িয়ে দেন। এর সুফল ভোগ করে
পৃথিবীব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষ। শুরু
হয় ব্লগভিত্তিক সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণা। শুরু
হয় বাংলা ব্লগজিন।
ওয়েবসাহিত্যের বিকাশ :
২০০৫ ও তদপরবর্তী সময়ে সামহোয়্যার
ইন, চতুর্মাত্রিক, সচলায়তন, আমার ব্লগ, বিডি নিউজ, পরবাস, লোটাকম্বল, জয়ঢাক
কফিহাউসের আড্ডা, গুরুচন্ডালী, কৌরব, সৃষ্টি প্রভৃতি ব্লগ সকল
বাংলা ভাষাভাষীর সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। বাংলা লেখালেখির ক্ষেত্রে ব্লগ একটি
শক্তিশালী মিডিয়ায় পরিণত হয়। সামহোয়্যারইন
ব্লগের ওয়েবভিত্তিক বাংলা লেখালেখির চর্চা একটি মাইলস্টোন
হিসেবে বিবেচিত হয় অদূরেই। ২০০৭ সালে বাংলা
ওয়েবে যুক্ত হয় 'সচলায়তন'
নামের আরও একটি
শক্তিশালী ব্লগ। সোশ্যাল
মিডিয়ার আধুনিকীকরণের ফলশ্রুতিতে ফেসবুক ও টুইটার
আসার পর তা আরও সংগঠিত হয়ে ওঠে। এই নতুন ধারায়
তৈরি হয় অজস্র লেখক। পরবর্তীতে
ওয়েব ম্যাগাজিন সাহিত্যে যুক্ত হয়। ব্লগের
ক্ষেত্রে সমস্যা যা ছিল
তা খুব ইউজার
ফ্রেন্ডলি ছিল না। লগইন ভিত্তিক, নির্দিষ্ট ব্্রাউজারে
ও ডেস্কটপ থেকেই মূলত দেখতে
হত। পাঠক
লেখকদের ইন্টারেকশনের অবাধ সুযোগ
প্রথমদিকে ছিল না। ব্লগে সাধারণত সিম্পল টেম্পলেট ব্যবহার করে টেক্সটের
ওপর বেশি জোর
দেওয়া হত। ওয়েব
ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ
নিয়মিত ও পিরিওডিকালি
শুরু হয়। ওয়েবজিন
সাধারণত অনলাইন ভার্সন হলেও অনলাইনের
পাশাপাশি এদের প্রিন্ট
ভার্সনও থাকে। অন্যদিকে
ব্লগ কনটেন্ট সাধারণত ফ্রি সার্ভিস
হলেও ওয়েব ম্যাগাজিন
চাইলে সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে তার সেবা
প্রদান করতে পারে। বর্তমানে পরস্পর, আর্টস বিডি নিউজ ২৪, গল্পপাঠ,
চার নাম্বার প্ল্যাটফর্ম, ঐহিক অনলাইন, দুনিয়াদারি, সৃষ্টি ইত্যাদি ওয়েবভিত্তিক সাহিত্য চর্চার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।
এন্ড্রয়েড ফোন
ও ওয়েবজিন :
এ পর্যায়ে আরও একটি বিশেষ
সংযোজনের কথা না বললেই নয়। তা হলো এন্ড্রয়েড ফোনের বহুল ব্যবহার। ডেস্কটপ কম্পিউটারের পাশাপাশি এন্ড্রয়েড ফোনে বাংলা
ফন্ট যুক্ত করায় তা অসংখ্য মানুষকে অন্তর্জালে যুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। এভাবেই
ব্লগ থেকে ওয়েবভিত্তিক
সাহিত্য যাত্রায় যুক্ত হয়েছে ওয়েবজিন।
ওয়েব সাহিত্যের ভালো মন্দ :
আপাতদৃষ্টিতে লিটল
ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনের
মধ্যে যে পার্থক্যগুলো
বিদ্যমান সেগুলো এরকম-
১। প্রকাশ ও পাঠকসংখ্যা:
লিটল ম্যাগ সাধারণত সীমিতসংখ্যায় প্রকাশ পায় ফলে
তা সীমিতসংখ্যক সাহিত্যপ্রেমীর কাছেই
পৌঁছায়।
ওয়েবসাহিত্য যেহেতু
অনলাইনভিত্তিক কাজেই এর পাঠক
সংখ্যা অগণিত। ইন্টারনেট
ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর এক বিশাল
অংশ এখানে সাহিত্যের স্বাদ নিতে সক্ষম।
২। দীর্ঘস্থায়িত্ব:
বেশির ভাগ সময়ই লিটল ম্যাগাজিন
ব্যক্তি উদ্যোগে ও অর্থায়নে
প্রকাশ পায়, ফলে লিটল ম্যাগাজিন অর্থানুকূল্য না থাকার
কারণে যে কোনো
সময়ই বন্ধ হতে
পারে।
ওয়েব সাহিত্যে ন্যূনতম ডোমেইন ভাড়া দিয়ে
সারা বছর সাহিত্য
করা যায়।
৩। পরিচালনা:
লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে একাধিক সাহিত্যনিষ্ঠ জনশক্তির প্রয়োজন পড়ে। ছোট
ছোট গ্রুপ অথবা সংগঠন
অথবা সমমনা বন্ধুবান্ধবরা এক্ষেত্রে একসাথে হয়ে কাজ
করে।
ওয়েবজিনের ক্ষেত্রে
এত বাধ্যবাধকতা নেই ফলে
মূল সাইটটি তৈরি হবার
পর তা প্রযুক্তিগত
ভাবে দক্ষ এবং
সাহিত্যচর্চা করেন এমন
একজন ব্যক্তি দিয়েও চালানো সম্ভব।
৪। যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা:
লিটল ম্যাগাজিন এক্ষেত্রে ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ। বাংলা
ভাষাভাষী সাহিত্যচর্চায় অপরাপর বাংলা ভাষাভাষী (প্রবাস ও পশ্চিম বাংলা) লেখকদের সাথে
যোগাযোগ একটি বাঁধা
এবং লেখা প্রকাশের
পর লেখককে সেই সংখ্যাটি
পৌঁছানোও ব্যয়বহুল। বেশির
ভাগ সময়ই লেখক
তার প্রকাশিত লেখাটি হাতে পান
না।
ওয়েব পত্রিকায় এই যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ। বাংলা
ভাষাভাষী লেখকদের দূরত্ব ঘুচিয়ে একই প্ল্যাটফর্মে
সাহিত্যচর্চার এই সুযোগ
ওয়েবসাহিত্যের ফলেই সম্ভব
ও সহজ হয়ে
উঠেছে।
৫। লেখার মান:
সৃজনশীল লেখাগুলোর
যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ থাকে বলে
এর মাধ্যমে শক্তিশালী লেখক তৈরি
হয়।
ওয়েবসাহিত্যে লেখক
পাঠক একই প্ল্যাটফর্মে
পাঠ এবং মন্তব্যপ্রদানে সক্ষম হওয়ায় অনেকসময়ই গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রভাব এখানে দেখা যায়।
ওয়েব সাহিত্যের অন্তরায় :
আবার ওয়েবজিনের রয়েছে কিছু অন্তরায়। যেমন:
১। সিরিয়াস সাহিত্যচর্চার অভাব।
২। আবহমান সাহিত্য যত রঙ রূপ, যত রকম পথ ও মতের
বিচিত্রতায় সমৃদ্ধ, ওয়েবজিন ততটা
এখন অবধি নয়। যেমন ভ্রমণ সাহিত্য, শিশু সাহিত্য, বিজ্ঞান-নির্ভর, কল্পবিজ্ঞান, রম্য রচনা, অপ্রতুল নারীবাদী সাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, জীবনী নির্ভর সাহিত্য, বিষয়মুখ নির্ভর
সাহিত্য নিয়ে কাজ
হলেও তা এখন
পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে নয়। সিরিয়াস
সাহিত্যের সমমানের হয়ে উঠতে
গেলে, সাহিত্যের সব ধারায় তার পথ চলা প্রয়োজন।
৩। কৃতি সাহিত্যিকদেরও ওয়েব সাহিত্যে
নিয়ে আসতে গেলে
প্রয়োজন ওয়েব সাহিত্যের
মানকে আরও উচ্চে
নিয়ে যাবার। এখনও
অবধি তেমন ব্যতিক্রমী
কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া বাকি
সব পত্রিকাই পাঁচ মিশালি
আয়োজনেই দায় সারে।
৪। সিরিয়াস সাহিত্যিক ও কৃতি
সাহিত্যিকদের প্রযুক্তি নির্ভর সাহিত্য থেকে মুখ
ফিরিয়ে থাকা।
৫। ওয়েবজিন পরিচালনায় সুচারু ভাবনাচিন্তার অভাব।
৬। ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড নিয়ে অস্বচ্ছ
ভাবনা। তবে
লেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য
লিটলম্যাগের মত ওয়েবও
দিনদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা, হারিয়ে যাওয়া লেখা এমন কি দুষ্প্রাপ্য অনেক সাহিত্যের
সন্ধানও এখানে সহজেই মেলে। নতুন
লেখকরা ওয়েবভিত্তিক সাহিত্যের মাধ্যমে সহজেই সাহিত্যচর্চা করতে সক্ষম
হচ্ছেন। ভবিষ্যতে
উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি
পাবে বলেই আশা
করা যায়। তবুও
আরও দু একটি প্রসঙ্গ
এখানে তুলে ধরা
উচিত বলে মনে
করছি। যেমন
ধরা যাক, ওয়েবভিত্তিক লেখালেখির
ক্ষেত্রে বড় সুবিধা
যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠকের মূল্যায়ন সরাসরি পাওয়া যায়। একটা
ওয়েবজিনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ
পাচ্ছে, ফেসবুকের সুবাদে
সে লেখা প্রচুর
শেয়ার হচ্ছে, কিন্তু চেনা পরিসরের বাইরে সকল পাঠকের
কাছেই তা সমানভাবে
পৌঁছাচ্ছে? অনেক সময়ই দেখা যায় লেখার
মান ততটা ভাল
নয় কিন্তু প্রশংসার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছেন
লেখক, অনেক ভাল লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছাতেই
পারছে না পরিচিতির
অভাবে অথবা একটি
যথেষ্ট ভাল লেখা
আলোচনার নামে আক্রমণের
শিকার হয়ে পড়ছে
যখনতখন। কাজেই
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া একই সাথে
পজিটিভ ও নেগেটিভ
উভয়ই হতে পারে।
ওয়েবজিনে সত্যিকার
পাঠপ্রক্রিয়া বোঝার উপায় যদি
কেবল গুগল অ্যানালিটিক্স হয় তা আমাদের কিছু তথ্য
প্রবাহে সক্ষম হলেও সম্পূর্ণ
তথ্য প্রদানে কি সক্ষম? পাঠক যদি কেবল
তার পরিচিত বন্ধু বা প্রিয়
লেখকের লেখাটিই পড়ে বেরিয়ে
যান বা পরে
পড়ব বলে ওয়েবজিন
থেকে একবার ঘুরে আসেন
তাহলে কেবল অ্যানালিটিক্স দেখে তা আদৌ বোঝা
সম্ভব নয়।
তাহারও প্রকাশ হোক কুহেলিকা করে উদঘাটন :
ওয়েবজিনে সাহিত্যের
মান রক্ষা না কি পত্রিকার প্রচার মূখ্য হবে নাকি
শুধুমাত্র ভাল লেখাই
প্রকাশ করা হবে
সে বিষয়গুলো ভাবা প্রয়োজন। ভাষার প্রতি লেখক-পাঠক-সম্পাদক সকলেরই দায়বদ্ধতা আছে সেটিও
ভেবে দেখার দরকার আছে বৈকি। প্রথাবিরোধী লেখালেখির ক্ষেত্র তৈরি করতে
যে লিটল ম্যাগ
আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তারই পথ ধরে ওয়েবজিনও তাহলে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আরও একটি
অনিবার্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতেই
পারে।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে
হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল-
না হয় থাকুক কিছু বর্ণনার
ছটা, ঘটনার ঘনঘটাও। থাকুক তত্ত্ব ও উপদেশ, ক্ষতি কী! হয়ত ওয়েব পত্রিকাও লিটল ম্যাগাজিনের
মতই অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল হয়েই থেকে
যাবে কিছু ভুল
নিয়েই। তবু
ভয় কিসের। পরীক্ষানিরীক্ষার পথ বেয়েই তো সিদ্ধান্তে
উপনীত হতে বলে
বিজ্ঞান। তেমন
বহু পথ, বহু মতের সমন্বয়েই না হয় প্রস্তুত হবে আগামীর
সাহিত্যের রূপরেখা। আর তাতে নিশ্চিত রূপেই ঋণ স্বীকারে
উল্লিখিত হবে লিটল
ম্যাগের মত ওয়েব
সাহিত্যর কথাও কেবল
স্মরণে রাখতে হবে যা,
চিন্তা ভাবনা গভীর হলে, ওয়েবজিনও হয়ে
উঠতে পারে লিটল
ম্যাগের সমান্তরালে চলা এক অনন্য সাহিত্যধারা, কিন্তু তার আগে, অন্তরায়গুলিকে অতিক্রম
করতে হবে। এবং
আশা করা যায়
আগামীতে নিজস্ব পথেই তার
সমাধান খুঁজে নিয়ে ওয়েবজিন
অচিরেই হয়ে উঠবে
লিটল ম্যাগের পাশাপাশি আগামী সাহিত্যের সম্ভাবনার রসদঘর।
এগিয়ে চলুক ওয়েবজিন।
শুভায় ভবতু।
No comments:
Post a Comment